সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপির সমঝোতার পরীক্ষাগার আজ মুর্শিদাবাদ, এই আঁতাত ভাঙতে ৫ জনসভা মমতার, শুরু ১৫ ই এপ্রিল
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন-চার বছর ধরেই বলছেন, রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে এক হয়েছে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি। এবারও লোকসভা ভোটের প্রচারে এই কথা একাধিকবার বলেছেন তৃণমূল নেত্রী। সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ করেছেন আরএসএস তত্ত্ব। উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় মমতার দাবি, বহরমপুর এবং জঙ্গিপুরে কংগ্রেসকে সাহায্য করছে আরএসএস।
মমতার এই কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে কংগ্রেস। আর কংগ্রেসের মতো জ্বলে না উঠলেও, ফোস্কা পড়েছে সিপিএমের গায়েও। কারণ, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণের মতোই এটা আজ বাংলায় সত্য, কংগ্রেস, বিশেষ করে অধীরের স্বাভাবিক মিত্র সিপিএম। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এখনও আরএসপির ওপর চাপ দিয়ে চলেছে, বহরমপুরে অধীরের বিরুদ্ধে কোনও লড়াই, প্রচার করা যাবে না। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, অধীর চৌধুরীর সাংসদ হওয়া নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রর যত না চিন্তা, তার থেকেও অনেক বেশি উদ্বেগে সূর্যকান্ত মিশ্র।
কিন্তু সিপিএম-কংগ্রেসের সম্পর্ক নিয়ে এই লেখা নয়। এই লেখার বিষয়, সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপিকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা?
আসলে রাজনীতিতে আপনি কী বললেন, তার সত্যতা কতটা, তার থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণ মানুষ সেই কথা বিশ্বাস করছেন কিনা? অন্তত নির্বাচনী রাজনীতিতে তো বটেই।
কংগ্রেসের সঙ্গে আরএসএসের আঁতাতের অভিযোগ মমতা এনেছেন মুর্শিদাবাদের দুই কেন্দ্রে। কিন্তু কেন? কী অবস্থা এই জেলার তিন কেন্দ্রে?
এই জেলার তিন কেন্দ্র, জঙ্গিপুর, বহরমপুর এবং মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপির প্রার্থী নির্বাচন, প্রচার, নির্বাচনী কৌশল থেকে এটা আজ জলের মতো পরিষ্কার, তৃণমূল নেত্রীর অভিযোগ ষোল আনা সত্য। আজ লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপির সমঝোতার পরীক্ষাগারের নাম মুর্শিদাবাদ।
জঙ্গিপুর
প্রণব পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় ২০১২ সালে জঙ্গিপুর লোকসভা উপনির্বাচনে দু’হাজারের কম ভোটে জিতেছিলেন। তারপর ২০১৪ সালে তিনি জেতেন আট হাজার ভোটে। ২০১৪ সালে তৃণমূল এই কেন্দ্রে মুসলিম প্রার্থী করেছিল। সিপিএম সেই সময় অভিযোগ করেছিল, জঙ্গিপুর কেন্দ্রে মুসলিম প্রার্থী করে তৃণমূল আসলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের সুবিধে করে দিয়েছে, যাতে তাঁর দিকে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ হয়। নিজে জিতবে না বুঝেই সিপিএমকে হারাতে অভিজিৎকে সুবিধে করে দিয়েছে তৃণমূল। দু’বারই স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু প্রার্থী দিয়েছিল বিজেপি এবং তারা ৮৫-৯০ হাজার করে ভোট পায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এবারও তৃণমূল মুসলিম প্রার্থীই (খলিলুর রহমান) দিয়েছে এই কেন্দ্রে, কিন্তু সিপিএম থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মাফুজা খাতুনকে কেন মালদহ থেকে এনে বিজেপি এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে, সেই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপির আঁতাতের উত্তর। গোটা রাজ্যে বিজেপি যেখানে প্রকাশ্যে হিন্দুত্বের কার্ড খেলছে, সেখানে এই কেন্দ্রে কেন মুসলিম প্রার্থী লড়ছেন প্রণব পুত্রের বিরুদ্ধে (আদৌ কি তিনি লড়ছেন), তা থেকেই স্পষ্ট বিজেপির তৃণমূল বিরোধী হিন্দু ভোটের একটা অংশ যেন সরাসরি অভিজিতের দিকে যায়, তাই চায় তারা। অন্য কেন্দ্রগুলিতে এই মেরুকরণের ফায়দা যেন বিজেপির দিকে যায়, কিন্তু এই কেন্দ্রে তা যেন যায় কংগ্রেসের বাক্সে। অথচ এই বিষয়টি নিয়ে এই কেন্দ্রের প্রচারে আশ্চর্যজনকভাবে চুপ সিপিএম।
বহরমপুর
এই কেন্দ্রে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজ্যে বিরোধীদের সম্মিলিত মুখ অধীররঞ্জন চৌধুরী। তার বড় প্রমাণ, কংগ্রেস যতই রায়গঞ্জে সেলিমের বিরুদ্ধে দীপা দাশমুন্সিকে প্রার্থী করুক না কেন, এই আসনে কোনওভাবেই প্রার্থী দিতে নারাজ সিপিএম। এমনকী জেলা আরএসপি ঈদ মহম্মদকে প্রার্থী করলেও, তিনি যে বামফ্রন্টের প্রার্থী নন তাও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর প্রার্থী পদ তুলে নেওয়ার জন্যও চাপ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, তাঁর হয়ে কোনও প্রচার করতেও নারাজ রাজ্য বা জেলা সিপিএম এবং রাজ্যের আরএসপি নেতৃত্ব। আলিমুদ্দিনের বার্তা স্পষ্ট, সব সিপিএম এবং বাম ভোটার কংগ্রেসকে ভোট দিন। আমাদের প্রার্থী নামেই আছেন, আমরা তাঁর সঙ্গে নেই। অন্যদিকে এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে এমন একজনকে, যাঁকে মুর্শিদাবাদ জেলা রাজনীতিতে কেউ কোনওদিন কোনও ভূমিকায় দেখেননি।
মুর্শিদাবাদ
জঙ্গিপুরের মডেলই বিজেপি নিয়েছে মুর্শিদাবাদেও। প্রার্থী করেছে একদা কংগ্রেস, পরে তৃণমূল, বর্তমানে বিজেপি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মুসলিম হুমাউন কবীরকে। এই আসনটিও বিজেপি কার্যত ছেড়ে দিয়েছে কংগ্রেস-সিপিএমকে। ঠিক যেভাবে ছেড়ে দিয়েছে জঙ্গিপুর এবং বহরমপুর।
এখন কথা হচ্ছে, বিজেপি এবং সিপিএমের সঙ্গে সমঝোতা করে পুরনো দুর্গ মুর্শিদাবাদ কি অক্ষত রাখতে পারবে কংগ্রেস? ভোটের এখনও বেশ কিছুদিন বাকি। আরও অনেক জল গড়াবে গঙ্গা দিয়ে। কংগ্রেসের দুর্গ ভাঙতে মমতা মুর্শিদাবাদের সেনাপতি করেছেন শুভেন্দু অধিকারীকে, যিনি গত এক বছরেরও বেশি সময় পড়ে আছেন এই জেলায়।
আর তৃণমূল নেত্রী নিজে এই জেলায় করবেন ৫ টি মিটিং, যা শুরু হচ্ছে আগামী সপ্তাহের শুরুতেই। ১৫ ই এপ্রিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিটিং করবেন বেলডাঙা এবং ভগবানগোলায়। পরদিন মিটিং করবেন কান্দি এবং রঘুনাথগঞ্জে। একদম শেষে ১৯ তারিখ বহরমপুরে।
এই জেলায় সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপির জোট ভাঙাই আজ তৃণমূল শিবিরের একমাত্র চ্যালেঞ্জ।
(এই লেখায় প্রার্থীদের পরিচয় দিতে গিয়ে একাধিকবার মুসলিম, হিন্দু এই শব্দগুলো লিখতে হওয়ায় আমি দুঃখিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই, বাংলার রাজনীতিতে যেন ধর্ম, জাতির প্রাধান্য না থাকুক। কিন্তু পরিস্থিতি আজ এমনই, তা অস্বীকার করারও কোনও উপায় নেই।)
Comments are closed.