চলে গেলেন ভারতের সংসদীয় রাজনীতির আর একটি বর্ণময় চরিত্র। আর কোনও দিন সংসদে শোনা যাবে না, ‘মিস্টার স্পিকার স্যার।’
বলছিলাম সিপিআই নেতা এবং অভিজ্ঞ বাম সংসদ গুরুদাস দাশগুপ্তের কথা। যেমন ছিলেন বাগ্মী, তেমনি ডাকাবুকো নেতা। চলনে বলনে ছিল না কোনও অহঙ্কার। পোশাক আসাকেও ছিল না তেমন আভিজাত্য। কিন্তু সংসদে কিংবা তার বাইরে কোথাও বক্তৃতা দিতে উঠলে বোঝা যেত, তিনি কত বড় পণ্ডিত।
জ্যোতির্ময় বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়দের পরে বাম সাংসদদের মধ্যে গুরুদাস দাশগুপ্তের নাম অবশ্যই করতে হয় দক্ষ সংসদ হিসেবে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি তিন ভাষাতেই তিনি ছিলেন তুখোড়। প্রথম এবং দ্বিতীয় ইউপিএ আমলে দেখেছি, গুরুদাস দা লোকসভা কিংবা রাজ্যসভায় ভাষণ দিতে উঠলেই সরকার পক্ষ নড়ে চড়ে বসত। এনডিএ জমানায় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ির সময়ও আমরা গুরুদাস দাকে নানা সময়ে সরকার পক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে দেখেছি।
গুরুদাস দা যেমন ছিলেন তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান, তেমনি সিপিআই দলের শ্রমিক সংগঠনেরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন। সংসদে তাঁর বিশেষ নজর ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলির নানা দুর্নীতির দিকে। গুরুদাস দা ইউপিএ এবং এনডিএ আমলে বহু রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার দুর্নীতির মুখোশ খুলে দিয়েছেন। বহু বিতর্কিত বিষয়ে সংসদে যৌথ সংসদীয় কমিটি হলে বিরোধীদের তরফ থেকে তাঁর নাম কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে প্রস্তাব করা হত। নানা রকম বিতর্কিত তথ্য জোগাড় করে তা দিয়ে সরকার পক্ষকে বিপাকে ফেলায় গুরুদাস দার জুড়ি মেলা ছিল ভার। তিনি নানান কেলেঙ্কারি নিয়ে সংসদে বলতে উঠলে সরকার পক্ষ চুপচাপ বসে থাকত।
আমার সঙ্গে গুরুদাস দার ব্যক্তিগত স্তরে পরিচয় ছিল। আমার বাবা প্রয়াত কুমুদ দাশগুপ্ত ছিলেন সাংবাদিক এবং মনে প্রাণে বামপন্থী। সেই সূত্রেই গুরুদাস দা আমাকে স্নেহ করতেন। আমার কাছ থেকে বাবার খোঁজ খবর নিতেন। আমি যখন বর্তমান পত্রিকার চিফ রিপোর্টার ছিলাম, তখন নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সিপিআইয়ের শ্রমিক সংগঠনের কোনও কর্মসূচি থাকলে গুরুদাস দা বলতেন, দেবাশিস, একটা প্রেস রিলিজ পাঠালাম, একটু দেখ। তবে সেই খবর না বেরলে কখনও তাঁকে কুপিত হতে দেখিনি। আবার কখনও কখনও দলের অভ্যন্তরীণ গোলমালের খবরে তাঁর নাম জড়িয়ে গেলেও কোনও দিন গুরুদাস দাকে রাগতে দেখিনি। বা ফোন করে বলতে শুনি নি, দেবাশিস, এটা কেন লিখলে, ওটা কেন লিখলে।
একটা সময় রাজ্য সিপিআইতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল খুব তিক্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। দলের কলকাতা জেলা পরিষদের সঙ্গে গোলমাল ছিল নন্দগোপাল ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন রাজ্য পরিষদের। গুরুদাস দা, পল্টু দাশগুপ্ত, অধ্যাপক জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়, নারায়ণ, কমল গাঙ্গুলি প্রমুখ ছিলেন একদিকে। অন্যদিকে ছিল নন্দ দার গোষ্ঠী। নন্দ দাও আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। নন্দ দা’দের সঙ্গে বিরোধ ছিল সাংসদ নারায়ণ চৌবে, বিধায়ক শক্তি বল প্রমুখেরও। কলকাতার সিআইটি রোডে লেনিন স্কুলে এই সব বিরোধ নিয়ে দলের অনেক বৈঠক হত। আমরা সাংবাদিকরা স্কুলের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম বৈঠকের গোলমাল কতটা গড়াল, তা জানার জন্য। আজ বলতে কুণ্ঠা নেই, দুই পক্ষেরই অনেকে বৈঠকের মাঝে বেরিয়ে এসে নানা খবরাখবর দিতেন। তার থেকে আমরা সাংবাদিকরা অনেক খবরের মশলা পেয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে রুদ্ধদ্বার ঘর থেকে আমরা গুরুদাস দার গুরুগম্ভীর গলায় চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেতাম। তাঁর গলাটা ছিল বেশ গম্ভীর। যাঁদের নাম করলাম, তাঁদের অধিকাংশই আজ আর নেই। মনে পড়ছে, সেই সময় সিপিআইয়ের গোষ্ঠী কোন্দল নিয়ে বিভিন্ন কাগজে অনেক খবর বেরত। কিন্তু গুরুদাস দা কিংবা নন্দ দা, কেউই সেই সব খবর নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন না। আজকের রাজনৈতিক নেতা- নেত্রীদের সঙ্গে আগের প্রজন্মের নেতা-নেত্রীদের এখানেই মস্ত ফারাক। আজ কোনও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে কিছু লেখা হলেই তিনি চটে যান সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। তা সে শাসক দলের নেতাই হন, বা বিরোধী দলের নেতাই হন। কেউ কেউ তো আবার মন পসন্দ খবর না হলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কাগজের মালিক বা সম্পাদকের কাছে নালিশ পর্যন্ত ঠুকে দেন। গুরুদাস দা’রা ছিলেন এ ব্যাপারে একেবারেই অন্যরকম।
আজকের প্রজন্মের সাংবাদিকরা গুরুদাস দাশগুপ্ত, নন্দগোপাল ভট্টাচার্য্যদের তেমন সান্নিধ্য পাননি। তাঁদের স্নেহ থেকেও বঞ্চিত তাঁরা। আমাদের সঙ্গে এই সব নেতার পরিচয় ছিল একেবারে ব্যক্তিগত স্তরে। সেটা অবশ্যই আমাদের কাছে বড় পাওনা। রাজনৈতিক নেতাদের সততা নিয়ে অনেকে নানা প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু গুরুদাস দা’দের সততা ছিল প্রশ্নাতীত। এখানেই তাঁরা বাজিমাত করে দিয়েছেন।
সারা দেশে এবং এই রাজ্যে বাম রাজনীতির সামনে বিরাট সঙ্কট। তার মধ্যেই বয়সের কারণে অনেকে বিদায় নিচ্ছেন। অনেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছেন।
এই ধরনের নেতাদের শূন্যস্থান কখনওই পূরণ হওয়ার নয়।
Comments are closed.