হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে সিপিএম-কংগ্রেসের জোটের রাস্তা খুলেছে। এতে লোকসভা ভোটে বাংলায় সিট বাড়তে পারে তৃণমূলের

কংগ্রেসের সঙ্গে জোট কিংবা আসন সমঝোতার ছাড়পত্র হায়দরাবাদের পার্টি কংগ্রেসে আদায় করেছেন বাংলার নেতারা। আর এব্যাপারে সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু, মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে বঙ্গ ব্রিগেডের ত্রাতার ভূমিকায় নেমে কংগ্রেস ইস্যুতে জয় ছিনিয়ে এনেছেন খোদ দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। বুধবার পার্টি কংগ্রেসের শুরুতে প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট রাজনৈতিক প্রস্তাব পেশ করার পর, বাংলার যে নেতারা নিকট আত্মীয় আইসিইউতে চলে গেলে যেমন হাল হয়, তেমন মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁরাই শুক্রবার সন্ধ্যায় নতুন উদ্যমে ছটফট করছেন। নেহাত অনেক বয়েস হয়েছে, না হলে অনেক নেতাই হয়তো একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতেন। কিন্তু বডি ল্যাঙ্গোয়েজে তাঁরা মনের আনন্দ চেপে রাখতেও পারছিলেন না। মনোভাব অনেকটা এমন, বাকি সব কাজ করাই আছে। এবার জোটে সিলমোহর পড়ে গেল, সুতরাং চিন্তার আর কিছু নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামক মহীরুহকে উৎখাত করে লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০-২২টা আসন পাওয়া কোনও ব্যাপারই নয়।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের জোটপন্থী নেতারা এমন দিবাস্বপ্ন দেখতেই পারেন। তাতে কারও কিছু বলারও নেই। এমন দিবাস্বপ্ন তাঁরা ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগেও দেখছিলেন। কিন্তু আজ ২০১৮ সালের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এটা ভেবে দেখা দরকার, সত্যিই সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হলে, এ রাজ্যে লোকসভা ভোটের ফলাফলে কোনও মৌলিক পরিবর্তন হবে?
রাজনীতিতে পরিস্থিতি কখনই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সব সময় তা পাল্টাতে থাকে। আর সেই কারণেই, রাজনীতি দুই আর দুই যোগ করে চার করার মতো সাধারণ পাটিগণিত নয়। রাজনীতি একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া। যেখানে নানান উপাদান মিশে নতুন নতুন উপাদান তৈরি হয়। কিন্তু নতুন উপাদানটা কী তৈরি হবে, তা নির্ভর করে কোন জিনিস কী পরিমাণে মেশানো হচ্ছে, কত তাপমাত্রায় বিক্রিয়াটা হচ্ছে, কোন পাত্রে মেশানো হচ্ছে, এমন হাজারটা এক্সটার্নাল ফ্যক্টরের ওপর। এই এক্সটার্নাল ফ্যাক্টরগুলো কখনই কারও হাতে থাকে না। আর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করা যে কোনও মানুষই জানেন, এত সব কিছুর পরও একটা জিনিস আছে। তা হচ্ছে, মানুষের অভিজ্ঞতা। এই পরিস্থিতে আলোচনা দরকার, এই রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং মানুষের অভিজ্ঞতার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে ৩৪ বছর নিরবিচ্ছিন্ন সরকার চালানো সিপিএম।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাম এবং কংগ্রেসের আসন সমঝোতার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। দীর্ঘ মিটিং, আলোচনার পর কে কোন আসনে লড়বে তা ঠিক হয়। রাজ্যের মোটামুটি দুই তৃতীয়াংশ আসনে লড়াই করে সিপিএমের নেতৃত্বে বামেরা এবং এক তৃতীয়াংশ আসনে প্রার্থী দেয় কংগ্রেস। রাজ্যজুড়ে প্রচারে ঝড় তুলে ২১১টি আসন জিতে বিরোধী জোটকে উড়িয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার দু’বছরের মাথায় রাজ্যে কী এমন ঘটল, যে আজ সিপিএম নেতারা মনে করছেন, ২০১৬ সালের ফলাফলকে প্রায় উলটে আগামী লোকসভা ভোটে ভাল রেজাল্ট সম্ভব? ২০১৬ বিধানভোটের রেজাল্ট এবং তার পরবর্তী বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে আমার দৃঢ় অনুমান, পরিস্থিতি সিপিএম-কংগ্রেসের পক্ষে অনুকুল তো হয়ইনি, বরং আরও খারাপ হয়েছে। ২০১৬ বিধানসভা ভোটের পর কোচবিহার, তমলুক, উলুবেড়িয়া লোকসভা এবং কাঁথি দক্ষিণ, মন্তেশ্বর, নোয়াপাড়া কিংবা সবংয়ে যে বিধানসভা উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে নিশ্চিতভাবেই রাজ্যে দু’নম্বর শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি। সিপিএমের গড় ভোট নেমে হয়েছে ৮-১২ শতাংশ। কংগ্রেস ভোট পেয়েছে নোটার থেকে দু’পাঁচ হাজার বেশি। বিজেপির ভোট বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে ২২-২৫ শতাংশে। কোনও কোনও আসনে তা ৩০ শতাংশও ছাড়িয়েছে। সোসাল মিডিয়ায় সিপিএমের ফলোয়ার যতই বাড়ুক না কেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে এরাজ্যে সিপিএমের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার সব লক্ষ্মণই স্পষ্ট। কিন্তু এই পরিস্থিতি হল কেন? আমার মতে, আজ সিপিএমের এই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার একটা বড় কারণ, ২০১৬ বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে খুন, জখম, সংঘর্ষ কোনওটাই ২০১১ সালের পর আবিস্কার হওয়া কোনও বিষয় নয়। মানুষের এই অভিজ্ঞতা আছে আগে থেকেই। আটের দশকের শেষদিক থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের দিকে দিকে সংঘর্ষ, খুনোখুনির বহু উদাহারণ আছে। কিন্তু ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হওয়ার পর, এই সংঘর্ষ, খুনোখুনির ঘটনায় শাসক দল অপরিবর্তিত থাকলেও, বিরোধী দলের জায়গায় কংগ্রেসের বদলে উঠে আসে তৃণমূল কংগ্রেস। ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোট থেকে শুরু করে এক্কেবারে ২০১১ সালে সরকার বদল পর্যন্ত কেশপুর, গড়বেতা, আরামবাগ, বোলপুর, নানুর, ভাঙড়, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম কিংবা লালগড়সহ যত জায়গায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়েছে, সবই হয়েছে সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের মধ্যে। একমাত্র মুর্শিদাবাদ জেলায় কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের গণ্ডগোল হোতও, কিন্তু বাংলার রাজনীতিতে তা ছিল অধীর চৌধুরীকেন্দ্রীক বহরমপুরের লোকাল ইনসিডেন্ট। অন্যদিকে, ২০১১ সালের সরকার বদলের পর কংগ্রেস ছিল তৃণমূলের সহযোগী শাসক দল। ফলে, পরিবর্তনের পর যত জায়গায় বিরোধীদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, সব ক্ষেত্রেই আক্রান্ত হয়েছে সিপিএম। কংগ্রেস কর্মীরা কিন্তু তৃণমূলের হাতে তেমন আক্রান্ত হননি। বরং কংগ্রেসের নেতা, বিধায়ক থেকে মন্ত্রী অনেকেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই, ২০১৬ সালে তৃণমূল সরকারকে উৎখাত করার যতটা আকাঙ্খা সিপিএম কর্মীদের ছিল, ততটা ছিল না কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে। বরং রাজ্যের নিচুতলার কংগ্রেস কর্মীদের একটা বড় অংশের কাছে এখনও সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে তুলনায়, দ্বিতীয়টি অনেক গ্রহণযোগ্য। মমতা বন্দ্যোপাধায় ব্যক্তিগতভাবে কংগ্রেস কর্মীদের কাছে সিপিএমের তুলনায় অনেক কাছের। আর সেই কারণেই ২০১৬ সালের ভোটে সিপিএম কর্মীরা যেখানে তাঁদের প্রার্থী নেই, সেখানে কংগ্রেসকে পুরোপুরি ভোট দিলেও, কংগ্রেস কর্মীরা কিন্তু সবাই সিপিএমে ভোট দেননি। বরং তা অনেকটাই পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই মানুষের অভিজ্ঞতা যেমন একদিকে সিপিএমের পক্ষে প্রতিকুল, তেমনই অন্যদিকে, আজ বঙ্গ রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাসায়নিক বিক্রিয়া অনেকটাই বিজেপির অনুকুলে। এর আরও একটা বড় কারণ, দিল্লিতে বিজেপির শক্তিশালী সরকার।
এই অবস্থায়, বাংলায় সিপিএম-কংগ্রেসের জোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে চিন্তার কোনও ব্যাপার নয়। বরং, কংগ্রেস-সিপিএম জোট একটা সম্মানজনক ভোট পেলে, বিরোধী ভোট ভাগাভাগির পুরো সুবিধেই পাবে তৃণমূল কংগ্রেস। সেক্ষেত্রে একা লড়েও ২০১৯ লোকসভা ভোটে সাধারণ ভাবনা-চিন্তায় যা সম্ভব, তার থেকেও বেশি আসন পেতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.