ফাঁসি বা মৃতুদণ্ড (Death Sentence) নিয়ে নতুন করে তোলপাড় দেশ। নির্ভয়া কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত ৪ জনের ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে কঠোর কেন্দ্র। ১ ফেব্রুয়ারি ফাঁসি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত, অক্ষয় ঠাকুর ও মুকেশ সিংহের। কিন্তু নানা কারণে ফাঁসির প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
এদিকে ফাঁসি নিয়ে কার্যত আড়াআড়ি বিভক্ত দেশ। এক পক্ষের যুক্তি, এরকম নৃশংস ঘটনার শাস্তি কেবলমাত্র মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত। অন্যদিকে আরেক পক্ষের প্রশ্ন, মৃত্যুদণ্ডে কি আদৌ অপরাধ কমার কোনও নজির আছে? এখন এ নিয়েই তুমুল তর্ক-বিতর্কের ঝড়।
এই প্রেক্ষিতে একবার দেখে নেওয়া যাক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ রিপোর্ট, যেখানে রয়েছে ২০১৮ সালে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সামগ্রিক মৃত্যুদণ্ডের খতিয়ান।
কী বলছে অ্যামনেস্টির রিপোর্ট?
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানাচ্ছে, ২০১৮ সালে বিশ্বের ২০ টি দেশে মোট ৬৯০ টি মৃত্যুদণ্ড (Death Sentence) কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৯৩। অর্থাৎ, ৩১ শতাংশ কমেছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সংখ্যা। অ্যামনেস্টি জানাচ্ছে, গত ১ দশকের মধ্যে ২০১৮ সালে সবচেয়ে কম মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এবং সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে চিন, ইরান, সৌদি আরব, ভিয়েতনাম এবং ইরাকে।
মৃত্যুদণ্ডে শীর্ষে চিন
মৃত্যুদণ্ড (Death Sentence) দেওয়ার ব্যাপারে ২০১৮ সালেও শীর্ষস্থানে কমিউনিস্ট দেশ চিন। তবে কতজনকে মোট মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নেই অ্যামনেস্টির হাতে। কারণ, চিনে মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটিকে স্টেট সিক্রেট হিসেবে ধরা হয়। ফলে সেই তথ্য বাইরে আসার সম্ভাবনা কম। রিপোর্টে এও বলা হয়েছে, ওই এক বছরের মধ্যে চিনে অন্তত এক হাজার মানুষকে ফাঁসিতে চড়ানো হয়েছে বলে মনে করা হয়।
বিভিন্ন বিদেশি পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিনে দুর্নীতির দায়ে বেশিরভাগ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে বছরের পর বছর ধরে দেদারে মৃত্যুদণ্ড দিলেও চিনে দুর্নীতির পরিমাণ কমেছে, এমন কোনও তথ্য নেই।
আরও জানতে ক্লিক করুন, জেলে কী ঘটে ফাঁসির আগের রাতে? ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকের ছেলে মহাদেব জানালেন নিজের অভিজ্ঞতা
ভারত-চিনে পার্থক্য কোথায়?
তবে ভারতের সঙ্গে চিনের মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে একটি চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। তা হল, আমাদের বিচারব্যবস্থায় শাস্তি ব্যাপারটিকে সংশোধনের প্রকরণ হিসেবেই স্বীকার করা হয়েছে, যে কারণে এখন জেলকে সংশোধনাগার বলা হয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তের সংশোধনের কোনও অবকাশ থাকে না। তাই মৃত্যুদণ্ড ভারতের বিচারধারায় এখনও ব্যতিক্রম হিসেবেই স্বীকৃত। চিন বা অন্যান্য কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তা নয়।
মৃত্যুদণ্ডে অপরাধ কমে না, এই যুক্তিতে ভর করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা নিষিদ্ধ হয়েছে। অ্যামনেস্টির রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্ত গোটা বিশ্বের ১৪২ টি দেশে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছে। আবার ওই একই বছর গোটা বিশ্বে মোট ১৯,৩৩৬ জনকে ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ শোনানো হয়েছে।
এশিয়া প্যাসিফিক
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনের রিপোর্টে উল্লেখ করছে, ২০১৮ সালে এই এলাকার ৯ টি দেশে মোট ১৩৬ টি মৃত্যুদণ্ড (Death Sentence) কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৯৩।
২০১৮ সালে জাপানে ১৫ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। অথচ, ২০১৭ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪। এক বছরের মধ্যে এত বিপুল বৃদ্ধি কোন কারণে? অ্যামনেস্টির রিপোর্টেই উল্লেখ রয়েছে, ১৯৯৫ সালে টোকিও আন্ডারগ্রাউন্ডে সারিন কেমিক্যাল হামলার মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা পায় ১৩ জন। ২০১৮ সালে সেই ১৩ জনকে একসঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৩ সালের পর ফের একবার এই দেশের মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তের সংখ্যা ডবল ডিজিট ছুঁল। অন্যদিকে, পাকিস্তানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ৭৭ শতাংশ কমে গিয়েছে। ২০১৭ সালে পাকিস্তানে ৬০ জনের ফাঁসি হয়। ২০১৮ সালে সেখানে মাত্র ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
এছাড়া এই এলাকার ১৭ টি দেশ মিলে মোট ১,১০০ মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। যা এক বছরের নিরিখে পিছনে ফেলেছে ২০১৭ সালকে (১,০৩৭)।
মধ্য প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা
২০১৮ সালে এই এলাকায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৫০১ জনকে। ২০১৭ সালে যে পরিমাণ ছিল ৮৪৭। এক বছরের মধ্যে এই এলাকায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রবণতা ৪১ শতাংশ কমেছে।
মূলত ৫ টি দেশ, ইজিপ্ট, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব এবং ইয়েমেনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রবণতা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। যদিও ইরান, সৌদি আরব ও ইরাক, এখনও এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া দেশগুলোর অন্যতম। শুধুমাত্র এই ৫ টি দেশে এক বছরে মোট ৪৫৪ টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে বলে জানাচ্ছে অ্যামনেস্টির রিপোর্ট।
তবে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর প্রবণতা দেখলে বোঝা যায়, এই দেশগুলোতেও মৃত্যুদণ্ডের ঠিক-ভুল নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। তবে ইরানে এখনও প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার রেওয়াজ অব্যাহত।
কমছে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রবণতা?
অ্যামনেস্টির তথ্য বলছে, ইরানে ২০১৭ সালে ৫০৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৫৩। অর্থাৎ, প্রায় ৫০ শতাংশ কম। ইরাকেও একই হিসেবে কমেছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরিমাণ। ইরাকে ২০১৭ সালে যেখানে ১২৫ জনকে মেরে ফেলা হয়েছিল, সেখানে ২০১৮ সালে তা কার্যত অর্ধেক হয়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ তে।
তিহাড় জেলের প্রাক্তন সুপার সুনীল গুপ্তা তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই, Black Warrant: Confessions of a Tihar Jailer–এ বিস্তারিতভাবে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি এবং তর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, মৃত্যুদণ্ডে অপরাধ কমে না। বরং এর মধ্যে দিয়ে প্রতিশোধের মানসিকতাকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মাত্র। পাশাপাশি বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ করে তাঁর যুক্তি, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্তর অর্থনৈতিক শ্রেণি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নির্ভয়া কাণ্ডের মত নৃশংস ঘটনার প্রেক্ষিতে স্রেফ সংশোধনের যুক্তিতে ফাঁসির বিরোধিতা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক চলুক, কিন্তু ভাবা দরকার, বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রেও কোনও নাগরিকের প্রাণ হরণের অধিকার রাষ্ট্রের থাকে কি না, তা নিয়ে। সুনীল গুপ্তা বলছেন, আমার বিশ্বাস, জেলখানা তৈরি হয়েছে অপরাধপ্রবণ মনকে বদলের উদ্দেশ্যে এবং দোষীর মানসিকতা বদলানো রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু একজন দোষীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাষ্ট্রও তো একই অপরাধ করছে। তাহলে রাষ্ট্র্রের অপরাধের সঙ্গে দোষীর অপরাধের পার্থক্য কোথায়?
Comments are closed.