বারোয়ারি দুর্গা পুজোয় সাবেকি থেকে থিমে বিবর্তন হঠাৎ করে হয়নি বটে কিন্তু কয়েক দশকে যেন আচমকাই বদলে দিয়েছে পুজো নিয়ে আলাপ-আলোচনা। Theme Puja -এর শুরু থেকেই একদল বলে আসছেন পুজোর আসল আবেগ নাকি জড়িয়ে সাবেকি দুর্গা প্রতিমা ও মণ্ডপে। অন্য পক্ষের মত পুজো, উৎসবের সঙ্গে শিল্পের যে সূক্ষ্ম অথচ বিশাল যোগ সেটাই ফুটে ওঠে Theme পুজোয়। সাবেকি বনাম থিমের এই লড়াই অব্যাহত। কিন্তু কবে থেকে শুরু হয়েছিল Theme Puja?
থিম পুজোর ইতিহাস (History of Theme Puja)
সালটা ১৯৮৫। চাঁদা তুলে সাবেকি পুজোর তখন রমরমা। তার মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী কাজ হচ্ছিল। সেই সময়ে ছড়িয়ে পড়ল শুদ্ধ শুচি, সুস্থ রুচি-র স্লোগান। শারদীয়া সম্মান দিতে এগিয়ে এল বেসরকারি একটি রং কোম্পানি। সেটাই হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন পুজো কমিটির মধ্যে। সুস্থ রুচির মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন সামঞ্জস্য। পুজো মণ্ডপ, আলোক সজ্জা, প্রতিমার মধ্যে সেই সামঞ্জস্য আনতে শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা। শুরু হল শারদীয় সম্মান, আর্থিক পুরস্কার পাওয়ার যুগ।
নব্বই সাল নাগাদ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে দুর্গাপুজো শুরু হল এক নতুন রূপ নিয়ে। বাঁশ, কাপড়ের সাবেকি পুজোর বদলে কোথাও শুরু হল প্লাস্টিকের বোতল, ফলের বীজ, শুকনো লংকা ইত্যাদি নানাবিধ জিনিস দিয়ে মণ্ডপ গড়ার কাজ। শিল্পীর ভাবনায় লাগল উৎকর্ষতার ছোঁয়া। নতুন ভাবনাগুচ্ছই হয়ে উঠল Durga Puja Theme -এর জনক। কলকাতার বারোয়ারি পুজোগুলো হয়ে উঠল থিম পুজো।
ভালো থেকে আরও ভালো হয়ে ওঠার লড়াইয়ে প্রতি বছর এক একটা পুজো কমিটি নিত্য নতুন ভাবনা নিয়ে হাজির হয়, বাঙালির কাছে এই পার্বণ ধরা দেয় বাণিজ্যের সঙ্গে শিল্পের মোড়কে। তা নিয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে থিম পুজোই শিল্পীদের নতুন উপার্জনের পথ খুলে দিয়েছে। নানা ভাবনার প্রকাশ ও প্রসার ঘটছে। সামনে এসেছে বিকল্প কেরিয়ার।
Durga Puja Theme – Music, Culture and Globalization
থিম পুজোর শিল্প ভাবনায় বড়ো জায়গা নিচ্ছে থিম মিউজিক। সেখানে ওস্তাদ রশিদ খান, কবির সুমন, নচিকেতার মতো স্বনামধন্য শিল্পীরা যেমন কাজ করছেন, কাজের সুযোগ বাড়ছে আনকোরা ও অপরিচিত শিল্পীদেরও। পুজোর থিম হিট করলে যাঁদের নাম ছড়িয়ে পড়ার দুর্দান্ত সুযোগ।
তাই দুর্গা পুজো আজ আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বজনীন। আর থিম পুজোই তাকে সেই জায়গা করে দিচ্ছে।
এবারের দুর্গা পুজোর থিম বৈচিত্র্য
অতিমারি করোনার মধ্যে এবার বারোয়ারি দুর্গা পুজোগুলোর বাজেট কিছুটা কমই। চোখ ধাঁধানো প্যান্ডেল, মানানসই আলোকসজ্জা আর Theme -এর বৈচিত্র্য দিয়ে দর্শনার্থীদের টানা এবার কিছুটা কষ্টকর। একেই করোনার মধ্যে ঠাকুর দেখতে কতজন বেরুবেন সে প্রশ্ন থাকছেই। তা বলে উচ্ছ্বাস থেমে নেই। কিন্তু দুর্গা পুজোর থিম-শিল্পীদের ভাবনার বেশিরভাগ জুড়েই রয়েছে করোনা!
করোনা যখন থিম
Theme Durga Puja -এর একটা বড় দিক হল সাম্প্রতিক কোনও ঘটনাকে রং, আলো, কারসাজির সাহায্যে উপস্থাপিত করা। গত ৮ মাসে অতিমারি করোনাভাইরাসের চেয়ে এত আলোচনা, জল্পনা, উদ্বেগ আর কোনওকিছুকে নিয়েই যে হয়নি এ কথা হলফ করে বলা যায়। তাই এবার পুজোর থিম ভাবনাতেও জাঁকিয়ে বসেছে করোনা। কেউ অসুরকে করোনাভাইরাস বলে দেগে দিয়েছেন, কেউ আবার এই নয়া অসুরকে বধ করতে একটু অন্যরকম শিল্প ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছেন।
- শিয়ালদহ যুবদলের চোখে যেমন করোনাই আসল অসুর। তাই যুবদলের অসুর এবার করোনাভাইরাসের মতো দেখতে। পুজো কমিটির থিম শিল্পী সাত্যকি সুরের কথায়, আমরা সবাই জেনে গিয়েছি, করোনাভাইরাস দেখতে কেমন। সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া দখল করে রেখেছে করোনা। এই ভাইরাসের ছবিটাও আমাদের খুব চেনা। সাত্যকির কথায়, করোনার চেহারার মধ্যে একটা হিংস্র ব্যাপার আছে। তাই, অসুরের মুখটা তিনি করোনার মতোই করছেন। এ বছর করোনারূপী অসুর দেখতে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে মাস্ক মুখে দর্শনার্থীরা ভিড় করবেন বলে আশাবাদী উদ্যোক্তারা।
- বেহালা ১১ পল্লি সর্বজনীন তাদের থিমে দেখাবে, কীভাবে দেবী দুর্গা মর্ত্যে এসে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সাধারণ মানুষের মনে শক্তি জোগাচ্ছেন। উদ্যোক্তাদের কথায়, করোনার সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। সেই কঠিন লড়াইয়ে আমাদের মনোবল বৃদ্ধি করতে পাশে থাকছেন মা দুর্গা। থিমের মাধ্যমে সেটাই দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরা হবে।
- সন্তোষপুর লেকপল্লির থিমেও এবছর সেই কোভিড-১৯। থিমের মাধ্যমে তারা তুলে ধরছে করোনা পরিস্থিতিকে। উদ্যোক্তাদের কথায়, এই দুঃসময়টাই আসল অসুর। করোনায় মৃত্যু হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাই করোনার চেয়ে শক্তিশালী অসুর তো আর কিছু নেই। সেটাই থিমের মাধ্যমে তুলে ধরবেন মণ্ডপে।
- বড়িশা ক্লাব, হিন্দুস্তান পার্ক থেকে বাঘাযতীন তরুণ সঙ্ঘ, সব বিখ্যাত পুজো কমিটির থিম ভাবনা এবার একটি ভাইরাসকে ঘিরেই। এই তিনটি পুজোর মণ্ডপ সজ্জার ভার থিম শিল্পী রিন্টু দাসের উপর। তিনি জানাচ্ছেন, তিনটি Pujor Theme ভাবনাই করোনা কেন্দ্রিক। আর করোনার প্রভাব তো কাজে থাকবেই। কারণ, আমি একজন শিল্পী। করোনার যন্ত্রণা, কষ্টকে বাদ দিয়ে এই বছর থিম তৈরির প্রশ্নই ওঠে না।
বাংলায় প্রায় ৩৭ হাজার দুর্গা পুজো কমিটির মধ্যে বেশিরভাগই Theme Puja করে থাকেন। করোনার মধ্যে স্পনসরে ভাটা পড়েছে, বাজেটে হয়েছে কাটছাঁট। তারপর করোনা পরিস্থিতিতে প্রশাসনের নানা নিষেধাজ্ঞা মেনে পুজো করতে হচ্ছে। এসবের মধ্যেও নিত্যনতুন ভাবনা এবং ছোট বাজেটের মধ্যে দিয়ে তা উপস্থাপনের চেষ্টায় কসুর করছেন না কেউ।
Comments are closed.