সিঁদুর-মঙ্গলসূত্র নিয়ে কোনও ফতোয়াই জারি হয়নি নুসরত জাহানের বিরুদ্ধে, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন altnews এর প্রতিবেদনে

অমুসলিমকে বিয়ে এবং সিঁথিতে সিঁদুর-গলায় মঙ্গলসূত্র পরার অপরাধে বসিরহাটের তৃণমূল সাংসদ নুসরত জাহানের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে দারুল উলুম। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় ফেলেছে এই খবর। কিন্তু altnews এর অন্তর্তদন্ত জানাচ্ছে, এই খবর সম্পূর্ণ ভুয়ো। এমন কোনও হুমকি বা ফতোয়া আদৌ দেয়নি দেওবন্দের দারুল উলুম।

সম্প্রতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বসিরহাটের তৃণমূল সাংসদ নুসরত জাহান। স্বামী ব্যবসায়ী নিখিল জৈন। সদ্য বিয়ে সেরে সংসদে শপথ নেন টলিউড তারকা নুসরত। সেই সময়ই তাঁকে শাড়ি, সিঁদুর, মঙ্গলসূত্রে দেখা যায়। আগাগোড়া বাংলায় শপথ গ্রহণের পর নুসরত পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন স্পিকারকে। বাংলার তারকার শপথ গ্রহণের এই ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তেই নুসরতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় সোশ্যাল মিডিয়া। এই প্রেক্ষিতেই সামনে আসে, দেওবন্দের ফতোয়া। altnews এর প্রতিবেদনে প্রকাশ, বিতর্কের সূত্রপাত ফতোয়া নয় বরং একটি বিবৃতিকে কেন্দ্র করে। ২৮ শে জুন সকালে এবিপি নিউজ দেওবন্দের আসাদ কাসিমের একটি বিবৃতি দেখায়। এবিপি নিউজ আসাদ কাসিমকে উলেমা বলে উল্লেখ করে জানায়, ‘সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে আমি জানতে পেরেছি বাংলা থেকে সাংসদ নুসরত জাহান সিঁদুর এবং মঙ্গলসূত্র পরে শপথ নিয়েছেন। তারপর বিভিন্ন সূত্র থেকে আমি জানতে পারি, তিনি একজন জৈন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। ইসলামে, একজন মুসলিম কেবলমাত্র মুসলিমকেই বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু তিনি অভিনয়ের জগতের লোক, ধর্ম মানেন না। তাই তাঁদের কাছে ধর্মাচরণ নিয়ে কথা বলার কোনও অর্থ হয় না। আমি কেবল শরিয়া নির্দেশিত পথের কথাই বলতে পারি’।

আসাদ কাসিমের এই মন্তব্যের পরই সংবাদমাধ্যম প্রতিক্রিয়া নিতে হাজির হয় বিজেপি নেত্রী সাধ্বী প্রাচীর কাছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্রাচীর মন্তব্যে নতুন করে সাম্প্রদায়িক জলঘোলা শুরু হয়। altnews এর প্রতিবেদন বলছে, এই সময় থেকেই আসাদ কাসিমের বিবৃতিকে ফতোয়া হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে মিডিয়ার একাংশ। সর্বভারতীয় ইংরেজি নিউজ চ্যানেল টাইমস নাউ আসাদ কাসিমের বিবৃতি সম্প্রচার করে এবং ‘হ্যাশট্যাগ নুসরত ভার্সেস ক্লেরিকস’ নামে বিপুল বহরে প্রচার চলতে থাকে ফতোয়ার। যদিও দেওবন্দের তরফে এমন কোনও ফতোয়াই জারি হয়নি। টাইমস নাউ একধাপ এগিয়ে আসাদ কাসিমকে মুফতি বলে অভিহিত করতে থাকে। যদিও এবিপি নিউজ আসাদকে উলেমা হিসেবে সম্বোধন করেছিল। টাইমস নাউয়ে দেওয়া আসাদ কাসিমের বিবৃতিতে ফতোয়া শব্দটি কোথাও না থাকলেও, সংশ্লিষ্ট চ্যানেলটি তাকে ফতোয়া হিসেবেই প্রচার করতে থাকে।

২৯ শে জুন দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আসাদ কাসিমের বিবৃতি প্রকাশ করে এবং দাবি করে ভিন ধর্মে বিয়ে করার জন্য দেওবন্দের দারুল উলুম নুসরত জাহানের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে। যদিও দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তার প্রতিবেদনে কোথাও কাসিমকে দারুল উলুমের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেনি। তা সত্ত্বেও আসাদের বিবৃতিকে দারুল উলুমের ফতোয়া হিসেবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

altnews এর পক্ষ থেকে আসাদ কাসিমের সঙ্গে কথা বলা হয়। আসাদ কাসিম সাফ জানান, তাঁর সঙ্গে দারুল উলুমের কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি জানান, কয়েকদিন আগে আজ তক এবং ই-টিভির দুই সাংবাদিক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে এবিষয়ে বক্তব্য চায়। সেই প্রেক্ষিতেই নিজের মতামত দিয়েছেন তিনি। যা কোনওভাবেই ফতোয়া নয়।

altnews এর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, দারুল উলুমের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও এমন কোনও ফতোয়ার উল্লেখ নেই। ফতোয়া জারি হলে, তা অবশ্যই লিখিত আকারে প্রকাশ করতে হবে, এটাই দারুল উলুমের নিয়ম। দারুল উলুমের এক আধিকারিক আশরাফ উসমানির সঙ্গে কথা বলা হলে, তিনিও নুসরতের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির বিষয়টি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। জানিয়েছেন, বাংলার সাংসদ নুসরত জাহানের বিরুদ্ধে দারুল উলুম কোনও ধরনের ফতোয়া জারি করেনি। আশরাফ উসমানি altnews কে আরও জানিয়েছেন, ‘ভারতের সংবাদমাধ্যম ইদানীং দৃষ্টিকটুভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা যেকোনও মৌলবির বিবৃতি সংগ্রহ করে, তাকে দারুল উলুমের ফতোয়া বলে সম্প্রচার করে দিচ্ছে’। যদিও ফতোয়ার সত্যতা খতিয়ে না দেখেই ততক্ষণে দেশজুড়ে সংবাদমাধ্যমে পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে ফতোয়া-রাজনীতি।

altnews এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হিন্দি নিউজ চ্যানেল আজ তক, এবিপি নিউজ, জি় নিউজ, ইন্ডিয়া টিভি, ইংরেজি ও হিন্দি নিউজ চ্যানেল এনডিটিভি, ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দু, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ডেকান ক্রনিকল, দ্য ইকনমিক টাইমস, হিন্দি সংবাদপত্র দৈনিক ভাস্কর, দৈনিক জাগরণ, অমর উজালা, প্রভাত খবর, সংবাদ সংস্থা এএনআই, নিউজ পোর্টাল স্ক্রোলে এই ভুয়ো ফতোয়াকে সত্যি হিসেবে ধরে নিয়ে খবর পরিবেশিত হয়েছে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ অপ ইন্ডিয়া এবং স্বরাজ্য পোর্টালেও একইরকম খবর পরিবেশিত হয়েছে। অথচ altnews এর তদন্তমূলক প্রতিবেদন স্পষ্ট জানাচ্ছে, এমন কোনও ফতোয়া দারুল উলুম কখনও জারিই করেনি। বায়বীয় এবং ভুয়ো ফতোয়া নিয়েই সপ্তাহভর মেতে রইল ভারতের সংবাদমাধ্যমের সিংহভাগ।

Comments are closed.