বিশ্বকাপ চলছে। বাঙালি এখন সঠিক অর্থে আন্তর্জাতিকতাবাদ অনুশীলন করছে বিভিন্ন দেশকে সমর্থনের মাধ্যমে। বাঙালির ফুটবলীয় মেরুকরণ মূলত মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গল নির্ভর হলেও, বিশ্বকাপের সময় এই মেরুকরণের প্রভাব কাটিয়ে বাঙালি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন, ইতালি (যদিও রাশিয়া বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ ), পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম প্রভৃতি নানা দেশের প্রতি নিজেদের জোরালো সমর্থন প্রদর্শনের জন্য নানাবিধ কৌশল নেয়। নানাভাবে বুঝিয়ে দেয়, ফুটবল নিয়ে তাঁদের অপরিসীম আবেগের মাত্রা। ফুটবল বাঙালি জীবনের অন্যতম চর্চা, ফুটবল কেবল তাঁদের কাছে খেলা নয়। ফুটবল তাঁদের কাছে অনুভূতি যা অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, হতাশা, ক্ষোভ, ব্যর্থতা ভুলানোর অব্যর্থ ওষুধ। ফুটবলে ‘বল দখল’ বলে একটি কথা চালু আছে, অর্থাৎ বল যার দখলে যত থাকবে, ম্যাচে তার আধিপত্য তত বেশি হওয়ার সম্ভবনা।
বিশ্বকাপের সময় ফুটবল নিয়ে বাঙালির চর্চা, পোস্ট, কমেন্ট, তর্ক, বিতর্ক, নানা সৃজনশীল রসিকতা প্রমাণ করে ফুটবল নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া দখলে কিন্তু বাঙালি অনেক অনেক এগিয়ে। ম্যাচ প্রতি ম্যাচ বিশ্লেষণ , বিভিন্ন দলের সমর্থনে পোস্ট, আবার পছন্দের খেলোয়াড়ের ছবি শেয়ার, বিপক্ষ টিমকে নিয়ে ট্রোল, রঙ্গে-রসিকতায় মজে বাঙালি। যখন ভারতীয় ফুটবলে বাঙালির অবদান ক্রমশ ফিকে হচ্ছে, খেলার মাঠে দখল নিচ্ছে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের দলগুলি। বছরের পর বছর জাতীয় লিগে বা বর্তমানে আই লিগে ট্রফিহীন বাংলার বড় দলগুলি ( ২০০৪-০৫ থেকে ১৭-১৮ এই ১৪ বছরে বাংলায় শেষ আই লিগ এসেছে ২০১৪-১৫ সালে মোহনবাগানের হাত ধরে )। যে ফুটবল সংস্কৃতি জন্য ভারতীয় ফুটবলের সাপ্লাই জোন হিসেবে পরিচিত ছিল বাংলা, সেখানে আজ প্রতিভার বড়ই অভাব। মান পড়তির দিকে, বড় ক্লাবগুলিতে এখন বিদেশি ও উত্তর-পূর্বের ফুটবলারদের দাপট। কেমন যেন বিবর্ণ ফ্যাকশে হয়ে উঠছে বাঙালি ফুটবল মাঠে প্রতিনিধিত্বের নিরিখে। অথচ এই বাংলা, এই ময়দানের সঙ্গে বহু বছর ধরে যুক্ত ভারতীয় ফুটবলের নক্ষত্র সৃষ্টির কৌলীন্য। বাংলা ছিল উর্বর ভূমি, যেখান থেকে ভারত কাঁপানো বহু রথী-মহারথী জন্ম নিয়েছেন, অসামান্য দক্ষতা, সৃষ্টিশীল ফুটবলের নিদর্শন রেখে মানুষের মন জয় করেছেন। বাঙালি হিসাবে আমাদেরকেও গর্বিত করেছে।
এই বাংলা ভারতীয় ফুটবলকে দিয়েছে চুনি, গোষ্ঠ পাল, বলরাম, কৃশানু, গৌতম, ভাস্কর, সুরজিত, প্রদীপ বন্দোপাধ্যায়, সেলিম, শান্তি মল্লিক, প্রসূন থেকে ফালফিলের ফুটবল নিয়ে মাঠে কারুকার্য দেখিয়ে সমীহ প্রশংসা আদায় করে নেওয়া মেহেতাব, নবি, দিপেন্দু, সুব্রত, অর্ণব, রফিককে। বাঙালি ফুটবলের ইতিহাস শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী। এই ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে ফুটবল বাঙালির ‘স্বদেশিকতার উত্তরণ’ ঘটিয়েছে, কীভাবে জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনে লড়াই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কীভাবে ফুটবলের মাধ্যমে সুক্ষভাবে স্বায়ত্তশাসনের পাঠ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যখন ১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ডে শিবদাস ভাদুড়ি, সুধীর চ্যাটার্জি, মনমোহন মুখার্জি, অভিলাষ ঘোষদের মোহনবাগান পিছিয়ে পড়েও অনবদ্য প্রাণশক্তিতে ভর করে আর অফুরন্ত দমে ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে ভারতীয় ফুটবলকে সাবালকত্বে আসীন করেছিলেন। ইতিহাসের পাতায় ভারতীয় ফুটবলকে অন্য মার্গে নিয়ে গিয়েছিল এই জয়। এই জয় কেবল ফুটবল মাঠে বিদেশি দলকে হারানোর ঘটনা নয়। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে পরাধীনতার গ্লানিকে ছিঁড়ে ফেলে মুক্ত বাতাসের সঞ্চার সহযোগে প্রতিটি ভারতীয়কে শিহরিত করে তোলার ঘটনা, শৃঙ্খলাবদ্ধ শ্রম ও কলা সমন্বয়ে রচিত জয়ের ভাস্কর্য, এক আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়-বাঙালি পারে খালি পায়ে খেলে ব্রিটিশদের হারাতে, নাস্তানবুদ করতে। প্রতীকী অর্থে এই লাগাতার আক্রমণ হয়ে উঠে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ক্রমাগত, নাছোড়বান্দা আন্দোলনের বার্তা। এই জয় ছিল স্পর্ধা, আত্মবিশ্বাস ও বাঙালি দেশাত্মবোধের সংহতিপূর্ণ কোরাসে স্বাধীনতালাভের প্রেরণা।
এর পর ফুটবল যত এগিয়েছে, বাংলার দাপট, বাঙালির আধিপত্য তত বেশি চেপে বসেছে ভারতীয় ফুটবলের উপর। ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকে শৈলেন মান্নার নেতৃত্বাধীন ভারত এক রোমহর্ষক ম্যাচে এই বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা ফ্রান্সের কাছে ২-১ গোলে পরাজিত হলেও চমৎকার ছন্দভিত্তিক ফুটবল বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়ে নেয়। ৮৯ মিনিটে গোলে ব্যবধান ২-১ করে ফ্রান্স। ১৯৫১ সালে এশিয়ান গেমস জেতার পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন প্রদীপ বন্দোপাধ্যায় এবং ইংল্যান্ড এফএ থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ অধিনায়কের মধ্যে একজন নির্বাচিত হন শৈলেন মান্না।
ফুটবল বাঙালি জীবনে এতটাই প্রভাব বিস্তারকারী, সত্যজিৎ রায়ের মত বিশ্বখ্যাত চিত্রপরিচালক তাঁর বিখ্যাত চলছিত্র ‘জন অরণ্যে’ দেখিয়েছেন, সাতের দশকে কীভাবে ফুটবল মানুষের সামাজিক সম্মানের সমান্তরাল সূচক হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই বাঙালি এখন প্রতিনিধিত্বের বিচারে ক্লাব বা দেশে সংখ্যালঘু বা বলা ভালো নুন্যতম। সদ্য সমাপ্ত ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপে ভারতের দুরন্ত পারফর্মেন্সে ঝলকানি ছিল, তেজ ছিল। ছিল বিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জেদ। কিন্তু তা সুনীল ছেত্রি, জেজে, অনিরুদ্ধ থাপা, শরপিত সিংহ নির্ভর, যেখানে প্রীতম কোটাল, শুভাশিস রায়, রফিকরা ম্লান। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের আবেগ নির্ভর ফুটবলকে হারিয়ে আইএসএলে বা জাতীয় স্তরে বাংলার রূপকথা লেখার দায়িত্ব তুলে নিচ্ছে অ্যাটলেটিকো কলকাতা। রূপকথায় লেখা থাকবে ভাড়াটে সৈন্যদের গৌরব গাঁথা, বাইরের খেলোয়াড়দের মস্তানিতে বিপক্ষকে নক আউট করে জেতার ভাষ্য।
কিন্তু বাঙালি কি তা নিয়ে ভাবিত? যে সংস্কৃতি ছিল বাঙালির আত্মমর্যাদার সঙ্গে জড়িত, যে ফুটবল ছিল বাঙালির পরিচয়, যে ফুটবলের ঘটনাবহুল ইতিহাস দেখিয়ে দেয় বাঙালি দুধে ভাতে নয়, ছিনিয়ে নিতে পারে বিপক্ষের নামী স্টাইকারের পা থেকে বল। আত্মসমর্পণ নয়, কঠিন রক্ষণকে ভেদ করে বল রাখে তিন কাঠিতে, তা আজ প্রায় পঞ্চত্বপ্রাপ্তির দিকে। ধংসের দিকে। ফুটবল মাঠে বাঙালির সম্মানজনক প্রতিযোগিতামূলক প্রতিনিধিত্ব যেন এখন জীবন্ত জীবাশ্ম, কেবলই স্মৃতি। বাঙালি ফুটবল নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক প্রতিনিধিত্বে নয়, সমর্থন প্রদর্শনমূলক সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে বাঙালির আগ্রাসনী আস্ফালন বিবর্তিত হচ্ছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ফ্রান্স, নেইমার, মেসি, কাভানি, মদ্রিচ, এমবাপে, গ্রিজম্যান, পোগবাকে কেন্দ্র করে। আটের বিশ্বের মারাদোনা ছিল, বাঙালির ‘আমাদের মারাদোনা কৃশানু’ ছিল, কিন্তু পরিবর্তিত সময়ে বাঙালি হয়তো ভাবেই না বা ভাবার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলেছে যে, বাংলা আমাদের জন্য বাঙালি সংস্করণের মেসি, নেইমার,সুয়ারেজ তৈরি করতে পারে। সবচেয়ে আশঙ্কার জায়গা, ফুটবলার তৈরির সঙ্গে বাংলায় যারা যুক্ত তাঁরাও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তাই বাঙালি ফুটবল মাঠে অস্তিত্ব আজ সংকটে ভুগছে। আমাদের তাই প্রবলভাবে দরকার সেই পিকের ভোকাল টনিক, যা বহু হারা ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছে বহু দলকে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় মগ্ন বাঙালি কি পারবে আবার সম্মানজনক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রতিযোগিতায় প্রায় হারতে চলা ম্যাচ আবার জিততে? খুব কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আর শিবদাস ভাদুড়ি, শৈলেন মান্নার লড়াকু ব্যাটন যাঁদের হাতে, তাঁদের কাছে কোনও কিছুই অসম্ভব নয় ।