রাজ্যপাল: উপঢৌকন হিসেবে তৈরি পদটার কাজই বিরোধী দলের সরকার থাকলে সংঘাত জিইয়ে রাখা

আমাদের পেশার প্রণম্য সাংবাদিক ও সম্পাদক ভি এন নারায়ণন ‘দ্য ট্রিবিউন’এ ১৯৮৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘পাপেট শোজ ইন রাজভবন’ শীর্ষক রচনাটিতে সরাসরি লিখেছিলেন, ‘Most Governors do not become the Centre’s agents; only the Center’s agents get appointed as Governors. ‘ শুধু আমাদের রাজ্যে কেন, জম্মু-কাশ্মীরের ও মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের সাম্প্রতিক কাজই জানান দিচ্ছে, ভি এন নারায়ণন কত যুক্তিযুক্ত কথা বলেছিলেন।
গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের নবান্নের কর্তারা যে গঙ্গার পূর্ব পাড়ের রাজভবনের সমান্তরাল কাজকম্মে বিরক্ত হবেন, এ তো স্বাভাবিকই। এই জগদীপ ধনখড় ভদ্রলোক আসাতক যে তর্কযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা কখনও মাটিতে কখনও গগনে। কখনও হেলিকপ্টারে, কখনও সড়কে। এখন সংযোজন হয়েছে নয়া নাগরিকত্ব আইনে।
এই সিএএ’র বিরোধিতায় এমনিতেই উত্তাল বাংলা। তার মাঝেই আরও উত্তপ্ত হল মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের সঙ্ঘাত।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অশান্তির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে মুখ্যসচিব ও রাজ্য পুলিশের ডিজিকে সোমবার সকালে তলব করেছিলেন রাজ্যপাল ধনখড়। কিন্তু তাঁরা যথারীতি যাননি। আর তাতেই চটে লাল রাজ্যপাল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকেই তলব করলেন। মুখ্যমন্ত্রী তো রাজভবনে পা মাড়াননি, বরং পাল্টা রাজ্যপালকে কড়া চিঠি পাঠিয়েছেন। সেই চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবেন না, রাজ্য সরকারকে সহযোগিতা করুন। আমার মতে রাজ্যপালের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা হল শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাজ্য সরকারকে সমর্থন করা। পরিস্থিতি আরও উত্তেজিত হতে পারে এমন উপাদানগুলোকে উস্কে দেওয়ার পরিস্থিতি যে এটা নয়, প্রকারন্তরে তা রাজ্যপালকে সমঝে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বিনীত ভাষায় এর চেয়ে কড়া জবাব আর কী হয়! এর পাশাপাশি, বরিষ্ঠ সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘সংবিধান সম্পর্কে রাজ্যপালের ধারণা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নন, তিনি তৃণমূলের সভানেত্রীও বটে। তাঁর দ্বৈত সত্ত্বা রয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসাবে কেন্দ্রের কোনও আইনের বিরুদ্ধে মিছিল করার অধিকার তাঁর অবশ্যই রয়েছে।’ মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি পেয়েও ফের জবাব দেন ধনখড়। রাজ্যপাল লিখেছেন, সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যেই তিনি রয়েছেন। চিঠির শেষে রাজ্যপার লিখেছেন, ‘আমাদের কালকের বৈঠকে আপনার দিক থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশায় আমি রয়েছি।’ এরপরেই সৌগত রায়ের টিপ্পনী, ‘ রাজ্যের শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্য মুখ্যমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত। তাঁর এখন কোথাও গিয়ে চা খেয়ে নষ্ট করার মতো সময় নেই।’
অনেকেরই মনে হতে পারে, রাজ্যপাল আসলে যত্নশীল। সরকার নিয়ে, রাজ্য নিয়ে খুবই ভাবিত। হ্যাঁ, ঠিক। ভাবিত, তবে কোন দিক থেকে সেটা বিচার্য। এই ভদ্রলোক কিন্তু ইতিমধ্যে নিজেকে অনেকটাই খুলে ফেলেছেন। বিশেষ করে বল ছাড়ার কথা বলেই। তিনি বললেন, ‘ক্রিকেট খেলায় প্রতি বল খেলতে নেই।’ তার মানে তিনি খেলার মধ্যেই আছেন। আছেন ব্যাটিং এন্ডে। আর খেলা মানেই দু’পক্ষের লড়াই, খেলোয়াড়দের কোনও না কোনও পক্ষে থাকতেই হয়। রাজ্যপাল ক্রিকেট প্রসঙ্গ এনে সরাসরি স্বীকার করে নিলেন তিনি আছেন পক্ষপাতে। একপক্ষের হয়ে তিনি ব্যাট করতে নেমেছেন। রাজ্যের শাসক দল বোধহয় তাই দেগে দিচ্ছেন ‘বিজেপির মুখপাত্র’, ‘বিজেপির পার্টিম্যান’ বলে। আর ক্রিকেট মাঠে থাকার কথা বলে আমাদের রাজ্যপাল সেই অভিযোগ মেনে নিলেন!
আমরা আরও দেখলাম সংবিধান দিবসের অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় রাজ্য বিধানসভায় ভাষণ দিতে যান, তখন রাজ্যপালের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখা হলেও তাঁরা একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেননি বা অনুষ্ঠানের আগে বা পরে একে অপরের দিকে তাকাননি পর্যন্ত। যদিও মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার অধ্যক্ষ, ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের নিয়ে ওই অনুষ্ঠানে সেই সময় উপস্থিত ছিলেন। এর পাশাপাশি ওইদিন রাজ্যপাল বিরোধী দলের নেতা ও বিধায়কদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মুখ্যমন্ত্রী নাম না-করে বলেন, ‘আমরা যখন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি, তিনি আমাদের দিকে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানান, আমরাও তাই করি। এটাই সৌজন্যে। সংসদের কেন্দ্রীয় হলে দেখা হলে আমরা সিপিএম নেতাদেরও শুভেচ্ছা জানাই। তবে এই ব্যক্তি … আমি তাঁর শুভ কামনা করি , দীর্ঘজীবন প্রার্থনা করি। তিনি আরও উপরে উঠুন এবং রাষ্ট্রপতি হোন। আমরা তাঁর জন্য প্রার্থনা করব। তবে জনগণ তাঁর কথাবার্তা পছন্দ করেন না, এবং তাঁর সৌজন্যতার অভাব রয়েছে।’ এসব কাণ্ড দেখে বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর প্রশ্ন, ‘নীতিগত কোনও বিরোধ আছে কি? ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাজ্যপাল এবং মন্ত্রীরা যা করছেন, তাতে কার কী লাভ হচ্ছে?’
আমরা দেখলাম সংবিধান দিবসে সুজনরা বিধানসভার অনুষ্ঠান বয়কট করে রাজভবনের অনুষ্ঠানে ছুটলেন। আর গদগদ ভাবে রাজ্যপালের অনুষ্ঠানের গুণগান করলেন। সুজন চক্রবর্তীদের আদেখ্যালা ব্যাপার থেকে স্পষ্ট ওঁরা রাজভবন বনাম নবান্নর সংঘাত তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে চান। অথচ এই সব নানান কারণে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে সব সময়েই বামপন্থীদের বিশেষত সিপিএমের প্রশ্ন ছিল। এমনকী, সিপিআই (এম)’এর জলন্ধর পার্টি কংগ্রেসে রাজ্যপাল পদটির বিলুপ্তির দাবিতে প্রস্তাব নেওয়াও হয়েছে।
তবে এটা ঠিক সিপিএম বা কংগ্রেস ধনখড়ের এই অতিসক্রিয়তায় যতই খুশি হোক, বাংলার সাধারণ মানুষ কিন্তু রাজ্যপালের এত কথায় বিরক্ত বোধ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার প্রতিফলন হচ্ছে। মমতা প্রায় আক্ষেপের সুরে মন্তব্য করেছেন, ‘২০১১ সাল থেকে আমরা ক্ষমতায় রয়েছি। কেশরী নাথ ত্রিপাঠী (প্রাক্তন রাজ্যপাল ) পুরোপুরি আরএসএস ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। সম্ভবত দলের নির্দেশে তিনি দু-একবার আমাদের বিরুদ্ধে নানা কথাও বলেছিলেন। তবে সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি ভাল ছিল। আমাদের মধ্যে কখনও এরকম ঝামেলা হয়নি।’ মমতার কাছে জগদীপ ধনখড়ের আচরণ অস্বাভাবিক লাগতে পারে কিন্তু আমরা যারা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের চর্চা করি তাদের স্মৃতিতে আছে গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষের দিকের কথা। তাদের কানে বাজে একটি স্লোগান, ‘ধরম বীরা বাংলা ছাড়ো, আভি ছাড়ো, জলদি ছাড়ো’। এই স্লোগানের জন্ম হয়েছিল বামপন্থী শিবির থেকে। তখন বাংলায় যুক্তফ্রন্টের ঋতু। ইন্দিরা গান্ধী তখন রাজভবনে পাঠিয়েছিলেন ধরম বীরাকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি অনৈতিকভাবে অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম অকংগ্রেসি সরকারের পতন ঘটিয়েছিলেন। রাজ্যপালকে কাজে লাগিয়ে সরকার ভাঙার খেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁরই কৌশলে কেরালার প্রথম সরকার তথা দেশের প্রথম কমিউনিস্ট সরকার, যার প্রধান ছিলেন ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, সেই সরকারকে মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগেই ১৯৫৯ সালে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেই ইন্দিরার আমলেই ধরম বীরার জায়গায় এলেন শান্তি স্বরূপ ধাওয়ান। যাঁর আমলে ১৯৭১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ২৮০ আসন বিশিষ্ট বিধানসভায় ১১১টি আসন জিতে সিপিআই (এম) একক বৃহত্তম দল হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রিসভা গড়ার ডাক পায়নি। উলটো কংগ্রেস (রেড্ডি) অর্থাৎ নব কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে অজয় মুখোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার গড়া হল, যার আয়ু ছিল মাত্র ২ মাস। ১৯৭১ সালের জুন মাসে অজয় মুখোপাধ্যায়ের সরকারের ইতি হল। আর সেই ফাঁক দিয়ে কেন্দ্রের পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক অভিনব মন্ত্রী হিসেবে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব এলেন, যা বকলমে সরকার চালানো।
এই অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে, ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ইন্দিরা গান্ধী ফের ক্ষমতায় ফিরলে, আলিমুদ্দিনের কর্তাদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিল। ইন্দিরা যখন ত্রিভুবন নারায়ণ সিংকে সরিয়ে ভৈরব দত্ত পান্ডে (বি ডি পান্ডে)’কে কলকাতার রাজভবনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন, তখন সিঁদুরে মেঘ দেখেই দুঁদে সিপিআই (এম) নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত বি ডি পান্ডেকে ভেঙে বললেন, ‘এসে গেছে বঙ্গ দমন পান্ডে।’ শুরুতেই এই ধাক্কাটা দিয়ে তখনকার বামফ্রন্ট নিজেকে সামাল দিয়েছিল। এবার অমিত শাহ যেমন প্রথামাফিক রাজ্যের সঙ্গে কোনও কথা না বলেই জগদীপ ধনখড়কে পাঠিয়ে দিলেন, তার মধ্যেও একটি বিশেষ ইঙ্গিত আছে। মনে পড়ছে, প্রয়াত বিখ্যাত আইনজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণা আইয়ার তাঁর দ্য ইন্ডিয়ান প্রেসিডেন্সি বইয়ে বলেছেন, ‘…the President ( in fact Prime Minister) may remove the Governor if he does not like his or her face or food habits.’ রসিকতার আধারে এর চেয়ে চরম সত্য আর কী হতে পারে! ফলে কেন্দ্রীয় সরকারকে খুশি করা ছাড়া এই রাজকীয় পদটির আর কী কাজ আছে!
স্বাধীনতার ঠিক পরে পরে ওই পদটা প্রথম রাখা হয়েছিল উপঢৌকন হিসেবে, পরে ওই পদটার কাজই বিরোধী দলের সরকার থাকলে সংঘাত টিকিয়ে রাখা। এর উল্টোটা আমরা আশা করতে পারি, কিন্তু বাস্তবে হবে না। বিরোধী সরকার থাকলে হাতে ‘কাঠি’ ধরিয়ে দিল্লি থেকে রাজ্যপাল পাঠানো হয়। আর বর্তমানে মোদী-শাহরা সাংবিধানিক প্রধানকে তার সঙ্গে ‘বাজি’ শব্দটা জুড়ে নিতে বলেছেন । তিনি রাজ্যের প্রথম সেবক অথচ তাঁকে ডাকা হয় না সব জায়গায়। চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি কোনও এক্সপোজার পেলেন না। জগদীপের মতে এটা গোটা পশ্চিমবঙ্গকে অপমান করার শামিল। এই যে শরীর ভরতি রাগ-অপমান-দুঃখ, তা কিন্তু জল হয়ে গেল ৩০বি, হরিশ চ্যাটার্জি
স্ট্রিটের কালীপুজোর নিমন্ত্রণ পেয়ে। একেবারে গদ গদ হয়ে গেলেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। আবার তারপর দিন ঘুম থেকে উঠেই তাঁর মনে পড়ে যায়, ‘ আমি কোথা হইতে আসিয়াছি? আমি কী করিতে আসিয়াছি।’ তিনি ফোঁস করেন। কারণে, অকারণে ফোঁস করেন। একটা অ্যাজেন্ডা যে তাঁর আছে, তা গোপন করার মতো কূট তিনি নন। তাই অতি সহজেই তাঁকে ধরা যায়। বিজেপির এ রাজ্যের নেতাদের সেই মুরোদ নেই যা দিয়ে মমতাকে টক্কর দিতে পারেন। আলিমুদ্দিন-বিধানভবন যুগ্মভাবে ধ্যারালো আর মুরলীধর তো নস্যি। তাই মোদী-শাহরা চাইছিলেন, এমন একটা লোক যে রাজ্য সরকারের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে বিবাদ করবে আর উন্মুক্ত করবে রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক মুখোশ।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

 

Comments are closed.