একদিকে খরার ভ্রূকুটি, অন্যদিকে ১৯ শে জুন পর্যন্ত দেশে বৃষ্টিপাত ৪৪ শতাংশ কম, দেশের অর্থনীতি তাকিয়ে আকাশের দিকে
ভারতে এবছর বর্ষার গতি শ্লথ। যে মৌসুমী বায়ুর কেরলে ঢোকার নির্ধারিত দিন ছিল ১ লা জুন, তা পিছিয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহ। শেষমেশ ৮ ই জুন কেরলে প্রবেশ করেছে বর্ষা। আর এই এক সপ্তাহ দেরিই কপালে ভাঁজ ফেলেছে অর্থনীতিবিদদের। জুনের ১৯ তারিখ পর্যন্ত গোটা দেশে ৪৪ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। তার প্রভাব সরাসরি পড়বে গ্রীষ্মকালীন কৃষি ফলনের উপর। পরিস্থিতি আরও শোচনীয় করে তুলেছে মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভয়াবহ খরা পরিস্থিতি।
বৃষ্টির ঘাটতির ফলে বিপর্যস্ত হতে পারে ভারতের মতো কৃষি প্রধান দেশের অর্থনীতি। একইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে পারে গ্রামীণ উপভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা। হাওয়া অফিস পূর্বাভাসে জানিয়েছে, এ বছর বর্ষা হবে স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের একমাত্র বেসরকারি আবহাওয়া দফতর মেটস্কাই জানাচ্ছে, ২০১৯ এ স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হবে।
বর্ষার প্রকারভেদ
আবহবিদরা জানাচ্ছেন, ১ লা জুন দক্ষিণ কেরলের সমুদ্রতটে বৃষ্টি শুরু হয়। তাকেই সরকারিভাবে দেশে বর্ষার প্রবেশ হিসেবে ধরা হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জুনের মধ্যভাগে যেখানে বর্ষার ঢুকে পড়ার কথা ছিল ভারতের অর্ধেক অংশে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখনও দেশের সিকিভাগেই ঠিক মতো বর্ষা শুরু হয়নি।
কোনও বছর বৃষ্টিপাত কম না বেশি, তা ঠিক করতে গত ৫০ বছরের গড় বৃষ্টির পরিমাণের সঙ্গে সেই বছরের বৃষ্টিপাতের পরিমাণের তুলনা করা হয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর, এই ৪ মাস বর্ষাকালে যদি দেখা যায়, গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় কোনও বছর মোট বৃষ্টি ৯৬ থেকে ১০৪ শতাংশ হয়েছে, তখন তাকে স্বাভাবিক বর্ষা বলা হয়। সাধারণত সেই মাত্রা ৮৯ সেমি কিংবা ৩৫ ইঞ্চি। আবার গড় বৃষ্টির পরিমাণের ৯০ শতাংশ হলে বলা হয় ঘাটতি। ২০১৮ সালে ভারতে ৯ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছিল, যদিও দেশের কয়েকটি এলাকায় সেই ঘাটতি পৌঁছেছিল ৩৭ শতাংশে। আবার গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় ১১০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হলে তাকে বলা হয় অতি বৃষ্টি বা বন্যা পরিস্থিতি। বন্যার জেরেও ফসলের প্রচুর ক্ষতি হয়, যার সরাসরি প্রভাব এসে পড়ে অর্থনীতিতে।
বর্ষায় বিলম্ব কি বৃষ্টিপাতে ঘাটতির ইঙ্গিত?
বিগত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় আবহবিদরা দেখেছেন, বর্ষা দেরিতে ঢুকলেই যে দেশে বৃষ্টিপাতে ঘাটতি দেখা দেবে, তেমনটা নয়। অনেক বছরই দেশে বর্ষার প্রবেশে দেরি হলেও, মরসুমের শেষে দেখা গিয়েছে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিক, কখনও স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি।
উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, ২০১৬ সালেও কেরলে বর্ষা ঢুকেছিল ৮ ই জুন। কিন্তু ১৩ ই জুলাইয়ের মধ্যে সারা দেশে পৌঁছে গিয়েছিল এবং সে বছর দেশে স্বাভাবিক বর্ষা হয়। জুনের ঘাটতি পূরণ করে দেয় জুলাইয়ের বৃষ্টিপাত।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এদেশের ৭০ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয়। প্রধানত এর উপর নির্ভর করে দেশে ধান, গম, আখ এবং তৈলবীজের ফলন। ভারতের ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ১৫ শতাংশই আসে কৃষি থেকে। অথচ কৃষি ক্ষেত্রে কাজ করেন দেশের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ। এই বিপুল পরিমাণ মানুষ দেশের সবচেয়ে বড় উপভোক্তা শ্রেণি। কৃষি ফলন ধাক্কা খেলে স্বাভাবিকভাবেই এই উপভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে। সরাসরি তার প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। আবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিক হলে, তার সুপ্রভাব কৃষিজীবী মানুষের পকেটবাহিত হয়ে মুনাফা বাড়ায় উৎপাদকদের। চাঙা হয় দেশের অর্থনীতি। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে, শ্যালো পাম্প চালাতে প্রয়োজনীয় ডিজেলও কম কিনতে হয় কৃষককে।
বর্ষায় ভরসা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং অর্থনীতির
উপভোক্তা মূল্য সূচককে ধরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অর্থনৈতিক পলিসি তৈরি করে। সেই নীতিরই একটি অংশ সুদের হার নির্ণয়। কোনও বছর দুর্দান্ত কৃষি ফলন হলে, খাদ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে।
পাশাপাশি খরা ঘোষণা হলে সরকারের তরফে দিতে হয় বিশেষ প্যাকেজ। তাতে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ লাফিয়ে বাড়ে। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত সেই খরচে লাগাম পরাতে পারে। একই সঙ্গে উপভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই দেশে কোনও বছর বৃষ্টিপাতের ঘাটতি সরাসরি প্রভাব ফেলে সেই দেশের অর্থনীতির উপর। ভারতের মতো কৃষি প্রধান দেশে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরের প্রাথমিক ঘাটতি কাটিয়ে বৃষ্টি কেমন হবে, তার দিকেই তাকিয়ে এখন তাকিয়ে দেশের অর্থনীতি।
Comments are closed.