বিভিন্ন মানুষের কাজের ক্ষেত্র আলাদা, জীবিকা আলাদা, আলাদা তাঁদের পারিবারিক অবস্থান, ব্যক্তিগত পরিস্থিতি ও চাহিদা। সেই চাহিদা ও প্রয়োজনের প্রশ্নেই আমাদের সবারই প্রায় এক লক্ষ্য। সেটা হল ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিনিয়োগ। আমরা সবাই নিজেদের আয় থেকে একটা অংশ বাঁচিয়ে রাখি সঞ্চয়ের জন্য। যা অদূর ভবিষ্যতে নিজের ও পরিবারের চাহিদা বা প্রয়োজন পূরণ করতে পারে।
কেন সেভিংস?
মানুষ মূলত দুই ধরনের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে সেভিংস করে। এক, রেনি ডেজ এবং দুই, এমার্জেন্সির সময়। একটু গুছিয়ে বলা যাক। এখন সারা বিশ্ব করোনা অতিমারিতে ত্রস্ত। এইরকম বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে মানুষ যখন তার উপার্জনের একটা অংশ সরিয়ে রাখে সেটাই রেনি ডেজ সেভিংস। আর এমার্জেন্সি সেভিংস হল পরিবারের কোনও চিকিৎসা, হঠাৎ করে কোনও কাজে বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন হওয়া ইত্যাদি। আবার রেনি ডেজ এবং এমার্জেন্সি, একসঙ্গে হানা দিতে পারে। যেমন করোনায় মারা গেলেন বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী। তাই এই দুটি জিনিসকে মাথায় রেখে সাধারণত মানুষ তাঁর আয়ের একটা অংশ সরিয়ে রাখে সঞ্চয়ের ভাঁড়ারে।
বিভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ফিনান্সিয়াল গোল
ধরা যাক, একই চাকরি করেন দুই যুবক। স্যালারিও পান একই কিন্তু তাঁরা একই অঙ্কের সেভিংস করবেন এমন কোনও মানে নেই। প্রতিটি মানুষের চাহিদা, পারিবারিক অবস্থা, পছন্দ-অপছন্দ আলাদা। তাই প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা ফিনান্সিয়াল গোল।
ফিনান্সিয়াল গোল হতে পারে স্বল্পকালীন এবং দীর্ঘমেয়াদি, দু’রকমের। কেউ দু’বছর চাকরি করে একটা গাড়ি কেনার পরিকল্পনা করে রেখেছেন এবং সেই লক্ষ্যে ডাউন পেমেন্টের জন্য কিছু সঞ্চয়ও করছেন। বাকিটা লোন করবেন বলে ভেবেছেন। সেটা তাঁর স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার আর্থিক বিনিয়োগ। মেয়ের বিয়ের জন্য কেউ তিল তিল করে জমাচ্ছেন তাঁর আয়ের অর্থ। সেটা হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনা।
পড়ুন: করোনা কালে মেডিক্লেম পেতে গেলে কী করণীয়?
ফিনান্সিয়াল প্ল্যান করুন ভেবেচিন্তে
জীবন বিমা, মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্স, মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট, রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগ- এগুলো সবই হল ফিনান্সিয়াল প্ল্যান। কিন্তু ফিনান্সিয়াল প্ল্যান হবে প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে আলাদা। একই বয়সী দুই চাকরিজীবীর আর্থিক পরিকল্পনা আলাদা হতে পারে। কারণ তাদের লক্ষ্য, পারিবারিক অবস্থা ভিন্ন। অর্থাৎ কেউ যদি পুরো সঞ্চয়ের অর্থই ইন্সিওরেন্স কিংবা মিউচুয়াল ফান্ডে ঢালেন তা অভিপ্রেত নয়। আবার পুরো সঞ্চয়ের টাকাই রিয়েল এস্টেটে লাগালেন, সেটাও ঠিক নয়। সুতরাং, ফিনান্সিয়াল প্ল্যানে যেটা দরকার তা হল সুসংহত সংমিশ্রণ। একটা ব্যালেন্স। যাতে আপনার বর্তমানে কিংবা অবর্তমানে সঠিক মানুষের কাছে, সঠিক সময়ে, সঠিক কাজে এবং সঠিক পরিমাণে সঞ্চিত অর্থটা কাজে লাগে। সেটাই হবে আদর্শ ফিনান্সিয়াল প্ল্যানিং।
রোজগার ও সঞ্চয়
যে কোনও মানুষের উপার্জন হয় তিনটি জিনিস দিয়ে- শরীর (body), মনন (mind) এবং সময় (টাইম)। কেউ বডি দিয়ে বেশি, মাইন্ড দিয়ে কম আবার কেউ মাইন্ড দিয়ে বেশি কিন্তু বডি দিয়ে কম, এই দুইভাবে উপার্জন করেন। কিন্তু এঁদের দুজনের কাছেই কমন ফ্যাক্টর হল সময়। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কোনও শ্রমিক তাঁর কাজটা করেন শরীর ও সময় দিয়ে। সেখানে ভাবনা-চিন্তার অবসর কম অথবা অদরকারি। কোনও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র রোজগার করেন মাইন্ড ও টাইম দিয়ে, সেখানে শারীরিক খাটুনি অতটা নেই। এই দুই ভাবে উপার্জন হতে পারে, হতে পারে পারিশ্রমিকের ফারাক। কিন্তু একজন শ্রমিক এবং একজন ইঞ্জিনিয়র, দু’জনেই সংসার খরচ, দৈনন্দিন ব্যয় বাদ রেখে একটা অংশ সরিয়ে রাখেন সঞ্চয়ে। এবং সেটা হয় বিভিন্ন টুল (Tools) এর মাধ্যমে। ভারতবর্ষে ৪০ হাজার এ ধরনের টুলস আছে, যার সাহায্যে আমরা রোজগারের অর্থ বাঁচাতে পারি। কিন্তু কোথায় সেই সঞ্চিত অর্থ রাখব সেটাই প্ল্যানিং। দেখতে হবে আমার বিনিয়োগের অর্থ যেন বর্ধিত হারে আমার কাছে ফিরে আসে এবং সেটা যেন ঠিক সময়ে ঠিক কাজে লাগাতে পারি। আবার আপনার অবর্তমানে সঠিক সময়ে যদি সঠিক মানুষের কাছে সেই সঞ্চিত ধন না পৌঁছয়, যে লক্ষ্যে এই বিনিয়োগ তা পূরণ হবে না। আবার সঠিক মানুষের কাছে সঠিক পরিমাণে অর্থ পৌঁছল, কিন্তু সেটা অনেক দেরিতে। সে ক্ষেত্রেও লক্ষ্য পূরণ হল না। ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসে এমন অনেক কেস দেখা গিয়েছে, যেখানে নমিনি না করায় সেই ব্যক্তির অবর্তমানে সঞ্চিত টাকা তাঁর পরিবার পায়নি।
ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসরের গুরুত্ব
কোন জায়গায় অর্থ বিনিয়োগ করলে তা অধিক পরিমাণে এবং নিশ্চিত ফেরত পাব, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আমার জন্য ঠিক, কোনটি নয় এসব ঠিক করার জন্য দরকার ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসর। একজন সঠিক ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসর হল গাইড বা লাইফ কোচের মতো। বাস্তবের রুক্ষ্ম জমিতে আপনি যত বড় খেলোয়াড়ই হন না কেন, একটা দুর্ঘটনা বা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে অসুবিধের মুখে পড়তে হয়। আর এখানেই ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসর বা কোচের ভূমিকা আসে। যিনি আপনার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অবস্থা এবং চাহিদা অনুযায়ী বাতলে দেবেন কোন বিনিয়োগটা আপনার পক্ষে ঠিক এবং কোন খাতে সঞ্চয় করলে আপনার পক্ষে অধিক লাভজনক হবে।
Comments are closed.