কিছুটা ঘী রংয়ের। আকৃতি খানিকটা তালশাঁসের মতো। সাইজ, যাকে বলে পেল্লাই। আর বস্তুটিও বিখ্যাত। মিষ্টি প্রেমী অথচ চন্দননগরের জলভরা তালশাঁস সন্দেশ খায়নি, এমনটা সাধারণত হওয়ার কথা নয়। এক সময়ের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য যেমন বিখ্যাত একই ভাবে শহরের সুনাম রয়েছে এখানকার জলভরা সন্দেশের জন্য। কিন্তু জানেন কী, এই জলভরা সন্দেশের জন্মের নেপথ্যে রয়েছে এক মজার ইতিহাস। শুধু তাই নয় সেই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ‘জামাই আদর’ও। চলুন জামাইষষ্ঠীর দিন বাঙালির এই প্রিয় মিষ্টির জন্মের ইতিহাসের হালহকিকত খুঁজে দেখা যাক।
সালটা ১৮১৮। চন্দননগর সংলগ্ন ভদ্রেশ্বরের তেলানিপাড়ায় ছিল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের জমিদার বাড়ি। তাঁদের পরিবারের বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বৈদ্যবাটির জমিদার বাড়িতে। প্রথম জামাইষষ্ঠীতে মেয়ে বাড়িতে আসছে। বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির গিন্নিদের ইচ্ছে নতুন জামাইকে ঠকাবেন। বাড়ির কর্তাদের কাছে রীতিমতো বায়না ধরলেন। এদিকে জামাই মানুষ বলে কথা, ঠকালেও সেটি যেন ‘মধুর’ উপায়ে হয়, তাও খেয়াল রাখতে হবে। সব দিক ভেবে ব্যানার্জি বাড়ির গিন্নিরা ঠিক করলেন, উপায় যখন মধুর, তখন মিষ্টি খাইয়ে জামাই ঠকানো হবে। এমন মিষ্টি বানাতে হবে যা খেয়ে জামাই বাবাজীবন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। এদিকে গিন্নিদের পরিকল্পনা জেনে ভারি মুশকিলে পড়লেন বাড়ির কর্তারা। শেষমেশ ডাক পড়ল অঞ্চলের বিশিষ্ট মিষ্টি প্রস্তুতকারক সূর্য কুমার মোদকের। ভদ্রেশ্বর চন্দননগর লাগোয়া জায়গায় ছিল তাঁর মিষ্টির দোকান।
এদিকে জমিদার বাড়ির ‘আদেশ’ শুনে ভারি ফাঁপরে পড়লেন সূর্য মোদক। বিস্তর ভাবনা চিন্তা করে তালশাঁস আকৃতির এক পেল্লাই সাইজ কড়াপাকের সন্দেহ তৈরি করলেন। কিন্তু তার ভেতরে ভরে দিলেন এক বিশেষ উপাদান। জামাইষষ্ঠীর দিন জমিদার বাড়ির গিন্নিরা জামাইয়ের পাতে তুলে দিলেন সূর্য মোদকের তৈরি সেই বিশেষ মিষ্টি। এদিকে গিন্নিদের অভিসন্ধি বুঝতে না পেরে জামাইও খুশি হয়ে সন্দেশে কামড় বসিয়েছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সন্দেশের ভেতরে থাকা গোলাপ জল ছিটকে জামাইয়ের গরদের পাঞ্জাবিতে। নতুন জামাইয়ের অবস্থা তখন তথৈবচ। আর জামাইকে ওই অবস্থায় দেখে উপস্থিত গিন্নিরা হেসে উঠলেন। মিষ্টি মুখও হল, অথচ জামাইকে ঠকানোও গেল। আর এভাবেই জন্ম নিল চন্দননগরের বিখ্যাত জলভরা তালশাঁস সন্দেহ।
জামাইষষ্ঠীর দিন তো বটেই, অন্যান্য দিনেও চন্দননগরের পুরোনো মিষ্টির দোকানগুলোতে জলভরা সন্দেশের প্রচুর চাহিদা থাকে। শোনা যায়, এই সন্দেশ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ভীষণ প্রিয় ছিল। চন্দননগরের পাতালবাড়ির ঘাটে কবির বজরা পৌঁছানো মাত্রই সূর্য মোদকের দোকানে খবর পৌঁছে যেত। সময় নষ্ট না করে সূর্য মোদকও জলভরা হাতে চলে আসতেন কবির কাছে।
Comments are closed.