ধর্মীয় হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাক রাজধানী দিল্লির উত্তর-পূর্ব এলাকা। মৃত্যুমিছিল আর পোড়া দোকানের কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়ায় কালো রাজধানীর আকাশ। অবস্থা এমনই যে পরিস্থিতি সামলাতে পথে নামতে হয়েছে এনএসএ অজিত ডোভালকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি কথা বলেছেন দিল্লীবাসীর সঙ্গে। নিজের কানে শুনে এসেছেন দিল্লি পুলিশের উপর মানুষের নির্ভরহীনতার কথা। কিন্তু যে দিল্লি পুলিশের প্রশংসায় এক সময় পঞ্চমুখ ছিল দেশের বাকি রাজ্যের পুলিশ বাহিনী, তার আজ এই দশা কেন?
ফল যেমন গাছের পরিচয়, ঠিক তেমনই কোনও পুলিশ বাহিনীর প্রধান যে ব্যক্তি, তাঁর উপরই নির্ভর করে কেমন কাজ করবে বাহিনী। দিল্লি পুলিশে তার ঘাটতি আছে, অভিমত রাজধানীর সিনিয়র সাংবাদিকদের একটি অংশের। কিন্তু কেন তাঁরা এমন মনে করছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে যেতে হবে একটু পিছন দিকে। মনে করুন দিল্লিরই একটি আদালতে ঘটা সেই দৃশ্যগুলোর কথা। যেখানে কালো কোট পরিহিত আইনজীবীদের মারমুখী মূর্তির সামনে দিল্লি পুলিশের অবস্থা হয়েছিল ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দারের মতো। প্রকাশ্যে আক্রান্ত হয়েছিলেন দিল্লি পুলিশের এক মহিলা আইপিএস। মনে রাখা দরকার, দিল্লি পুলিশ সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন।
পিঙ্ক ফ্লয়েডের রজার ওয়াটার্সের মুখে আমির আজিজের কবিতা, সিএএ কে বললেন ফ্যাসিস্ট ও রেসিস্ট, আরও জানতে ক্লিক করুন
রাগে-ক্ষোভে-অসহায়তায় সেদিন সাধারণ পুলিশ কর্মীরা ঘেরাও করেছিলেন দিল্লি পুলিশের সদর দফতর। ভেতরে আটকে পড়েছিলেন সিপি পট্টনায়ক। রাজধানীর প্রবীণ সাংবাদিকরা বলছেন, সেদিনই সিপি অমূল্য পট্টনায়ক সতর্ক হলে আজকের পরিস্থিতি দেখতে হত না হয়ত।
কিন্তু কে এই অমূল্য পট্টনায়ক?
১৯৮৫ ব্যাচের AGMUT (অরুণাচল প্রদেশ, গোয়া, মিজোরাম ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সমূহ) ক্যাডার অমূল্য পটনায়কের জন্ম ওড়িশায়। দিল্লির পুলিশ কমিশনার পদে বসেন ২০১৭ সালের শুরুতে। এ বছর জানুয়ারিতে তাঁর অবসর নেওয়ার কথা থাকলেও দিল্লি বিধানসভার ভোট ও সিএএ বিরোধী বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে তাঁকে এক্সটেনশন দেওয়া হয়। সিপি পদে বসার আগে অমূল্য পট্টনায়ক ছিলেন দিল্লি পুলিশেরই ভিজিল্যান্স ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের স্পেশাল কমিশনার পদে।
আরও জানতে ক্লিক করুন, দাঙ্গা ছড়ানো নিয়ে দিল্লি পুলিশকে কী বলার পরই রাতারাতি বদলি হলেন বিচারপতি?
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ১৯৭৯ সালে উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেন অমূল্য পট্টনায়ক। তারপর দিল্লি চলে যান তিনি। ১৯৮১ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। পড়াশোনায় বরাবরই তুখোর অমূল্য পট্টনায়ক এরপর বসেন ইউপিএসসি পরীক্ষায়। ১৯৮৯ থেকে ৯৩ সাল পর্যন্ত অমূল্য পট্টনায়ক ছিলেন পন্ডিচেরির এসএসপি। দিল্লি পুলিশে প্রথম সামলান নজফগড়ের এসিপির পদ।
তারপর ধাপে ধাপে উন্নতির শিখরে। কিন্তু এই গোটা ঘটনা প্রবাহে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিতর্কিত ঘটনা।
দিল্লির অভিজাত জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় পুলিশের অতি সক্রিয়তা যখন সংবাদমাধ্যমে বিতর্কের বিষয় হয়েছিল, তখন বাহিনীর প্রধানের নাম অমূল্য পট্টনায়ক। আবার জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গেরুয়া সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে পুলিশের আলস্য যখন শিরোনামে, তখনও দিল্লি পুলিশের ভার সেই অমূল্য পট্টনায়কের কাঁধেই। দুই ঘটনাতেই এখনও একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। শাহিনবাগ কিংবা জামিয়ায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের গুলি চালানোর সময়ও পুলিশের ভূমিকা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু সে সবই হয়ত বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেত, যদি না দিল্লিতে শুরু হয়ে যেত এক অভূতপূর্ব দাঙ্গা।
চারদিন ধরে চলা সেই হাড় হিম করা হিংসায় নতুন করে কাঠগড়ায় দিল্লি পুলিশ। সত্যতা যাঁচাই না করা হাজার হাজার ভিডিও ঘুরে বেরাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাতে কোনওটিতে ঢিল ছুড়তে সাহায্য করছে দিল্লি পুলিশের কর্মরত জওয়ানরা আবার কোথাও ভিড়কে ধ্বংসলীলা চালাতে দিয়ে নিজেরা ব্যস্ত রাস্তায় লাগানো সিসিটিভি ভাঙতে। আর সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগ রাজধানীর আকাশে বাতাসে ভেসে বেরাচ্ছে তা হল, প্রয়োজনের সময় ডেকেও দেখা মেলেনি দিল্লি পুলিশের।
অশান্ত দিল্লিতে প্রাণ গিয়েছে দিল্লি পুলিশের কর্মীদেরও। আহত হয়েছেন শতাধিক পুলিশ কর্মী। এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠছে, সেদিন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের হুমকি হজম না করে পুলিশ যদি তাঁকে গ্রেফতার করত, মানুষের কাছে সদর্থক বার্তা পৌঁছত। কিন্তু তা করা হয়নি। রাজনীতিকে সীমা ছাড়াতে দেওয়া হয়েছে। এমনকী হাইকোর্টের নির্দেশের পরও বিজেপির নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করেনি দিল্লি পুলিশ। তার ফলই হাতেনাতে পাচ্ছেন দিল্লির বাসিন্দারা। আর প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের, মনে করছেন দিল্লির হিংসা বিধ্বস্ত এলাকার বাসিন্দারা।
অমূল্য পট্টনায়ক। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে জ্বলন্ত দিল্লিতে এই নামের ব্যঞ্জনা ভিন্ন। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, দিল্লি পুলিশের কমিশনার অমূল্য পট্টনায়ক নিজের চোখ ধাঁধানো কেরিয়ারে দিল্লি হিংসাকে কি মেডেল হিসেবে সাজাবেন নাকি কলঙ্কের কালি?
Comments are closed.