এপ্রিলে পুর ভোট: দলের পুরনো কর্মীদের ফেরাতে মমতার বার্তায় ঘুম ছুটেছে বহু কাউন্সিলরের, শুদ্ধকরণের বার্তা প্রশান্ত কিশোরের
লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পর থেকেই তৃণমূলের দলীয় সভা, বৈঠকগুলিতে নেত্রী মমতা ব্যানার্জি নিয়ম করে দলে শুদ্ধকরণের বার্তা দিয়ে চলেছেন। প্রতিটি সভায় তিনি বলছেন, কোন জেলায় কোন নেতার সঙ্গে কোন নেতার ঝগড়া, কার সঙ্গে কার কথা বন্ধ, এই সব খবর আমার কাছে আছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, সামনে কলকাতা কর্পোরেশন-সহ প্রায় ১১০ টি পুরসভার ভোট। পুর ভোটে টিকিট পেতে হলে লবিবাজি বা দাদা-দিদি ধরে লাভ নেই। স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির লোক খুঁজে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী দিতে হবে। বুধবার কৃষ্ণনগরে দলের বৈঠকে তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, যাঁরা ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছেন, পুর ভোটের আগে তাঁদের কাছে টেনে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, নেতারা নন, কর্মীরাই দলের সম্পদ।
কিছুদিন আগে ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর এবং তৃণমূল যুব সভাপতি অভিষেক ব্যানার্জিও দলের বৈঠকে জানিয়ে দিয়েছেন, পুর ভোটে টিকিট পেতে গিয়ে লবিবাজি করা চলবে না। দাদা-দিদি, নেতা-নেত্রী ধরে টিকিট মিলবে না।
সম্প্রতি কলকাতায় এক বৈঠকে প্রশান্ত কিশোর উত্তরবঙ্গের তপন কেন্দ্রের বিধায়ক, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদাকে গ্রামে তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি বানানো নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। মন্ত্রীকে তিনি বলেছেন, আপনার বাড়ির আশপাশে সকলের ছোট, কাঁচা বাড়ি। তার মাঝখানে আপনি এত বড় প্রাসাদ বানিয়ে ফেললেন? এ নিয়ে নানা লোক তো নানা কথা বলছেন।
অনেক পুরসভায় তৃণমূলের গোষ্ঠীবাজির ফলে নাগরিকরা পরিষেবা পাচ্ছেন না। নেত্রী সেই পুরকর্তাদেরও সতর্ক করে দিয়েছেন। এই কারণে বেশ কিছু পুরসভার বোর্ড তিনি ভেঙেও দিয়েছেন।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, কলকাতা কর্পোরেশনের প্রার্থী বাছাই নিয়েও ভোট-কুশলী খুব সক্রিয়। তাঁকে নেত্রী রীতিমতো ফ্রি হ্যান্ড দিয়ে দিয়েছেন। প্রশান্ত কিশোর তাঁর টিমকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন। সূত্রের খবর, তিনি ওয়ার্ড ধরে ধরে রিপোর্ট তৈরি করে নেত্রীকে দিয়েছেন। প্রশান্ত কিশোরের স্ক্যানারে নাকি বেশ কয়েক জন কাউন্সিলরের ‘অপকীর্তি’ ধরা পড়েছে। তিনি বলে দিয়েছেন, এপ্রিল মাসে পুর ভোট। এখন থেকেই তাই সবাইকে কাজে নেমে পড়তে হবে।
এই সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূল নেত্রী আগামী পুর ভোটকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। তার অবশ্য কারণও আছে। আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আগে এই পুর ভোট দলের কাছে সেমি ফাইনাল। লোকসভা ভোটে বিজেপি নয় নয় করে আঠারোটি আসন দখল করার পর নেত্রী টের পেয়েছেন, দলের অনেক খামতি রয়েছে। এক শ্রেণির নেতা, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েতের বিভিন্ন স্তরের সদস্য যে নানা ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, তা প্রকাশ্যে এসে পড়েছে দলের ভোট-পরবর্তী পর্যালোচনায়। তাঁরা কাটমানি খেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। লোকসভা ভোটের পর তা নিয়ে জেলায় জেলায় তুলকালাম হয়েছে। ঘেরাও, বিক্ষোভ, মারধর- কোনও কিছুই বাদ যায়নি। এতে বড় ভূমিকা ছিল বিজেপির। ইতিমধ্যে এই ক্ষত মেরামত করার জন্য নেত্রী প্রশান্ত কিশোরকে নিয়োগ করেছেন। এখন গোটা দল চলছে তাঁরই দেখানো পথে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, লোকসভা ভোটের পরে সেই ক্ষত অনেকটাই মেরামত হয়েছে। তার উপর সিএএ, এনআরসি, এনপিআর বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরেও বিজেপিকে বেশ কোণঠাসা করা গিয়েছে। নেতৃত্বের উপলব্ধি, এটাই শেষ কথা নয়। আগামী বিধানসভা ভোটের আগে পুর ভোটে বড় ধরনের সাফল্য দরকার। তাই খোদ নেত্রী থেকে শুরু করে অন্য নেতারাও পুর ভোটের উপর বেশি জোর দিচ্ছেন।
নেত্রী যে ভাবে পুরনো নেতা-কর্মীদের কাছে টেনে আনার কথা বলছেন, তাতে তাঁরা আশায় বুক বাঁধছেন। এক শ্রেণির নেতা, জনপ্রতিনিধির দুর্ব্যবহার, অপকর্ম, দাদাগিরিই যে সৎ, পরিচ্ছন্ন নেতা-কর্মীদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এটা কালীঘাটের নেতারা বুঝেছেন। তাই তাঁরা পুর ভোট নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন। আর তাতেই ঘুম ছুটেছে বিভিন্ন পুরসভার ‘কীর্তিমান’ জনপ্রতিনিধিদের। কার টিকিট কাটা যাবে, কে টিকিট পাবে, তা নিয়ে সকলেই ধন্ধে রয়েছেন। আবার নেত্রীর স্পষ্ট নির্দেশ, লবিবাজি চলবে না। ফলে কেউ আর অন্তত প্রকাশ্যে তদ্বিরের পথে হাঁটছেন না, লবিও করতে পারছেন না। নেতৃত্ব অবশ্য এতে খুশি। কারণ, ওষুধে কাজ হতে শুরু করেছে।
Comments are closed.