বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে, দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাংলায় সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস কার্যত জোট বাঁধল। ২৫ নভেম্বর রাজ্যে যে তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হতে চলেছে, তাতে বাম ও কংগ্রেস জোট বেঁধেই লড়াই করবে। জোটের নীতি মেনে কংগ্রেস কালিয়াগঞ্জ এবং খড়গপুরে প্রার্থী দিচ্ছে। সিপিএম লড়াই করবে করিমপুরে। দু’পক্ষই জানিয়েছে, তিন কেন্দ্রে একে অপরকে সাহায্য করবে। বাংলার রাজনীতিতে বিষয়টি অভূতপূর্বও বটে।
২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের সময় বাম এবং কংগ্রেস জোট করে লড়াই করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। যার জন্য দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত লোকসভা ভোটের আগেও বাম এবং কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়াই করার কথা বলেছিল। সেই প্রচেষ্টা অনেকখানি এগিয়েও গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী দেওয়াকে ঘিরে মনোমালিন্য হওয়ায় সেই প্রচেষ্টাও ভেস্তে যায়। বস্তুত লোকসভা ভোটে লড়াই হয় বহুমুখী। কেবল বহরমপুর এবং মালদহ দক্ষিণে বামেরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়নি। দেখা গেল, দুই দলেরই শোচনীয় ফলাফল হয়েছে। কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র দুটি আসন। সিপিএম বা বামফ্রন্টের ঝুলি ছিল একেবারেই শূন্য। পাশাপাশি দুই দলেরই প্রাপ্ত ভোটও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। তাদের ভোট সাত শতাংশের কাছাকাছিতে নেমে এসেছে। এই ভোট ভাগাভাগির ফসল অনেকটাই ঘরে তুলেছে বিজেপি। তারা সকলকে তাক লাগিয়ে ১৮ টি আসন দখল করতে পেরেছে। পক্ষান্তরে তৃণমূলের আসন ৩৪ থেকে ২২-এ নেমে গিয়েছে। যদিও গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের নিরিখে তাদের ভোট শতাংশ তেমন কমেনি। কিন্তু বিজেপির ভোট শতাংশ ওই দুই ভোটের তুলনায় বেড়ে গিয়েছে। তৃণমূলের আসন সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে যেমন অ্যান্টি ইনকমবেন্সি ফ্যাক্টর কাজ করেছে, তেমনি তাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। বিজেপি কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই গোটা উত্তরবঙ্গে তৃণমূলকে একেবারে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিয়েছে। লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। ভোটের পর থেকেই প্রশান্ত কিশোরের টিম কাজ শুরু করে দিয়েছে। এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রশান্ত কিশোরের টিমের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে বলে তৃণমূলের অন্দরের খবর।
তৃণমূল এবং বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য বামেদের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য রাজ্য কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী অনেকদিন ধরেই সক্রিয়। লোকসভা ভোটের আগে দু’পক্ষের নেতারা একাধিকবার বৈঠকও করেছেন। দুই দলেরই শীর্ষ নেতারা বুঝতে পেরেছেন, তারা কেউ একক শক্তিতে বিজেপি আর তৃণমূলের মোকাবিলা করতে পারবে না। তার জন্যই তারা জোট করতে রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছে। বস্তুত এই তিনটি উপনির্বাচন বাম এবং কংগ্রেসের কাছে বড় মাপের অ্যাসিড টেস্ট। এই দুটি পক্ষ যদি উপনির্বাচনে ভালো ফল করতে পারে, তাহলে ২০২০ সালের পুরভোট এবং ২০২১-এর বিধানসভা ভোট একটা অন্য ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। এমনিতেই বাম এবং কংগ্রেসের ভোট প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। কালিয়াগঞ্জ একসময় কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি ছিল। একইভাবে খড়গপুর বিধানসভা কেন্দ্রও ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে পর্যন্ত কংগ্রেসের দখলে ছিল। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে খড়গপুরে জিতে আসছিলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা জ্ঞানসিং সোহনপাল। গত বিধানসভা ভোটেই তিনি বিজেপির দিলীপ ঘোষের কাছে হেরে যান। লোকসভা ভোটে এই দুই কেন্দ্রেই বিজেপি অনেক এগিয়ে রয়েছে। সেখানে তৃণমূল আছে দ্বিতীয় স্থানে। বাকিরা আরও নীচে। করিমপুরে বিধানসভা ভোটে তৃণমূল বিপুল ভোটে জিতেছিল। সেখানে মুসলিম ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর।
সম্প্রতি মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানায় কংগ্রেস বেশ ভালো ফল করেছে। দুই রাজ্যেই মিত্রশক্তির সঙ্গে জোট বেঁধে তারা বিজেপিকে বেশ বেগ দিয়েছে। তার থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়ে রাজ্যের কংগ্রেস নেতারা বিধানসভা উপনির্বাচনে বামেদের জোট বাঁধার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তাঁদের সেই প্রচেষ্টা সফল হওয়ায় অবশ্যই সোমেন মিত্ররা আত্মশ্লাঘা বোধ করতে পারেন। এখন দেখতে হবে, এই জোট কতটা কী করতে পারে, পাশাপাশি ৬ মাস আগে বিজেপির যে উত্থান হয়েছিল লোকসভা ভোটে, তা অব্যাহত থাকবে কিনা। আর তৃণমূল প্রশান্ত কিশোরের সৌজন্যে লোকসভা ভোটের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারে কিনা।
Comments are closed.