লকডাউনের জেরে গৃহবন্দি অবস্থা হলেও, আমার খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। আমার বাড়ি কলকাতার এজেসি বোস রোডের উপরে হলেও, এই সময়টায় মাঝে-মধ্যেই মনে হচ্ছে কলকাতায় নয়, বোলপুরে রয়েছি। চারিদিকে এত নিস্তব্ধতা। দুপুরে বাড়ির বারান্দায় বসে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।
আমার বাড়ির পেছনে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বেশ বড় জায়গা রয়েছে। এক সময় সেটিকে বাস ডিপো হিসেবে ব্যবহার করা হত। কিন্তু প্রায় ১৫ বছর ধরে জমিটি আদালতের বিচারাধীন। আর তাই ওই জায়গাটি এই মুহূর্তে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কাজেই নানা রকমের গাছপালা ও বন-জঙ্গলে ভরে উঠেছে জায়গাটি। এবং সেখানেই হরেক রকমের পাখি এসে ইদানিং বাসা বেঁধেছে। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর কাঠবেড়ালি। এই কাঠবেড়ালিদের অবশ্য আমরা রোজই খাবার দিই। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে তাদের সংখ্যা বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে।
এছাড়াও বসন্তগৌরি এবং বেশ কিছু মাছরাঙ্গা পাখিও দেখা যাচ্ছে ইদানিং, যা খুবই ভাল লক্ষণ। তো দুপুরটা তাদের ডাক শুনে আর বই পড়তেই কেটে যায়। যদিও গোটা দেশ এই করোনাভাইরাসের আতঙ্কে কাঁপছে, আমার কাছে কিন্তু এটা খুবই সুন্দর একটা সময়।
আমার দুই ছেলে। বড় ছেলে বেঙ্গালুরুর ম্যারিওটে চাকরি করে। এই লকডাউনের কিছুদিন আগেই বাড়ি ফিরেছে। আর ছোট ছেলে ক্লাস ১১ এ পড়ে। আমরা সবাই এখন একসাথে বসে মনোপলি খেলি। এছাড়াও নিজের জন্য এখন অনেক সময় পাচ্ছি। অনেক নতুন নতুন বই পড়ছি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা তারানাথ তান্ত্রিক সমগ্র পড়ছিলাম, এছাড়াও ম্যারি লুটেন্স-এর লাইফ অ্যান্ড ডেথ অফ কৃষ্ণমূর্তি সহ উইলিয়াম ডালরিম্পাইলের লেখা দ্য অ্যানারকি’ও পড়ব এর মধ্যেই। এছাড়াও শঙ্করের একাদশ অশ্বারোহীও পড়ে শেষ করেছি। আর প্রত্যেক বাঙালি বাড়িতে যেরকম হয়ে থাকে, প্রচুর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছি, সঙ্গে সুমনের গান ও মহিনের ঘোড়াগুলি তো আছেই।
আমি সাধারণত সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে পড়ি। কারণ, সকাল ৭ টায় আমার যোগ ব্যায়ামের ইন্সট্রাক্টার চলে আসেন। তবে এখন অবশ্য কিছুটা দেরি করেই উঠছি ঘুম থেকে। আর হ্যাঁ, একটু রান্নায় হাত পাকানোর চেষ্টা চলছে। স্ত্রীকে একটু সাহায্য করছি বলতে পারেন। বেশ কিছু নতুন খাবার বানিয়েছি। আমি যেহেতু নিরামিষ খাই, তাই ওটাই বানাই। আর সবাই বেশ ভাল খাচ্ছেও, প্রশংসাও পাচ্ছি। বেশ ভালোই লাগছে।
তবে এর ফাঁকে অফিসের কাজও কিছুটা এগিয়ে রাখছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। তবে কাজ তো এখন অনেকটাই কম। পরিবারের সবাই এখন একসাথে রয়েছি। আমার মনে হয়, এটা ফ্যামিলি বন্ডিং-এর একটা অনেক বড় সুযোগ যেটা হয়ত আর আসবে না। এর মধ্যে একদিন 1917 দেখলাম। এছাড়াও অ্যামাজন প্রাইমে মির্জাপুর নামক একটি ওয়েব সিরিজও দেখেছি। ভাইরাসটা এখনও দেখা হয়নি, এবার ওটা দেখব।
টেলিভিশনে নতুন করে রামায়ণের সম্প্রচার শুরু হয়েছে। এবং আমি সেটা দেখছি। এই রামায়ণ দেখার সাথে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রতি রবিবার যখন এই রামায়ণের সম্প্রচার হত, তখন পাড়ার বেশ কিছু মানুষ আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হতেন। সবাই মিলে হইহই করতে করতে রামায়ণ দেখতাম। এখন সেসব গল্প আমার ছেলেদের কাছে করি। তাঁরা শুনে বেশ অবাকই হয়।
এই লকডাউনের ব্যাপারটা আমি একটু আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম। তাঁর স্পেনসার্স থেকে বেশ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলি দিয়েই কাজ চলে যাচ্ছে। আর আমাদের বাড়িতে একজন সিকিউরিটি গার্ড আছেন, তিনিই সপ্তাহে একদিন বাজার করে নিয়ে আসেন। এই লকডাউনের জেরে তিনিও বাড়ি ফিরে যেতে পারেননি। আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে ও দিদিদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি, যেখানে চারিদিকে সব কিছুই কেমন চুপচাপ, একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা কাজ করছে। এই বিগত কয়েকদিনে মনে হয়েছে যেন প্রকৃতি আমাদের অনেক কাছে চলে এসেছে। অনেক পাখি এসে আমার বারান্দায় ভিড় করে, এই লকডাউনের জেরে তারাও অনেক সমস্যায় পড়েছে। ঠিক মত খাবার পাচ্ছে না। আমিও তাই একটু বেশি করেই খাবার রাখছি সেই সমস্ত শালিক, চড়াই পাখিগুলোর জন্য।
আমার বড় ছেলে মোবাইল গেমিং-এর ভক্ত। সে নিজের মত গেম খেলেছে। এছাড়াও আমার দুই ছেলেরই বই পড়ার দিকে একটু ঝোঁক রয়েছে। আমার বাড়িতে বইয়ের একটা লাইব্রেরি আছে। সেখান থেকে বই নিয়ে এসেও তাঁরা পড়ছে।
রোজকার যান্ত্রিক জীবনে এই লকডাউন কিছুটা হলেও আমাদের সবাইকে নিজেদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বাধ্য করেছে। দূষণ বহু মাত্রায় কমে গেছে। তাহলে কি এই লকডাউনের জেরে পৃথিবীর আয়ু কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেল? এর উত্তর অবশ্য সময়ই বলবে।
(কাঞ্চন দত্ত ইনার সার্কেল অ্যাডভারটাইজিং-এর ফাউন্ডার ডিরেক্টর এবং অ্যাডভারটাইজিং ক্লাব, কলকাতার প্রেসিডেন্ট)
(অনুলিখন: অভিজিৎ দাস)
Comments are closed.