ছুটিতে ফিরেছিলেন বাড়িতে, কিন্তু স্ত্রী, সন্তানদের ভুলে ঝাঁপালেন কেরলের বন্যা দুর্গতদের উদ্ধারে। পড়ুন মেজর হেমন্ত রাজের কথা

ভারতীয় সেনার ২৮ নম্বর মাদ্রাজ শপথ শক্তি কমান্ডের অফিসার মেজর হেমন্ত রাজ। ইচ্ছে ছিল এবছর ওনাম উৎসবটা কেরলে নিজের গ্রামে ফিরে কাটাবেন পরিবারের সঙ্গে। তাই আগে ভাগেই ছুটির দরখাস্তও করেছিলেন। পেয়েওছিলেন ছুটি। কিন্তু ছুটি কাটাতে নিজের বন্যা বিধ্বস্ত রাজ্যে ফিরে যা করলেন ভারতীয় সেনার এই মেজর, তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ঘটনার শুরু গত ১৮ অগাস্ট।
দিল্লি থেকে বিমানে কোচি যাওয়ার জন্য তিনি পৌঁছোন দিল্লি বিমানবন্দরে এবং গিয়ে জানতে পারেন ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত নিজের রাজ্যের কথা। হেমন্ত রাজের কথায়, ‘আমি জানতে পারি যে, আমার পরিবার ত্রাণ শিবিরে রয়েছে এবং আমার গ্রাম সম্পূর্ণ জলের তলায় চলে গিয়েছে। আমাকে বলা হলো, কোচিগামী বিমানও বাতিল করা হয়েছে।’ পরিবার ত্রাণ শিবিরে রয়েছে জানতে পারলেও, যেহেতু সে সময় কেরলের বিস্তীর্ণ অংশে টেলি যোগাযোগ ও নেট সংযোগ বিপর্যস্ত ছিল, তাই পরিবারের সদস্যরা ঠিক কোন ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন তা আর জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি এই সেনা অফিসারের। এরপর তিনি বেসরকারি এক বিমান সংস্থার আধিকারিকদের অনুরোধ করেন কোচি না হলেও তাঁকে যেন তাদের তিরুবনন্তপুরগামী বিমানে বসার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। বিমান সংস্থার আধিকারিকদের নিজের পরিচয় জানিয়ে বলেন, তিনি নিজের রাজ্যের মানুষের এই বিপদে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চান। মেজর হেমন্ত রাজের কথা ফেলতে পারেননি বিমান সংস্থার আধিকারিকরা। ১৮ তারিখ রাত ২ টোয় তিরুবনন্তপুর বিমানবন্দরে পৌঁছোন হেমন্ত।
সেখানে পৌঁছে তিনি বায়ু সেনা অফিসারদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের অনুরোধ করেন চেঙ্গানুরে তাঁকে ‘এয়ার ড্রপ’ করে দিতে। কারণ সেখানে অবস্থা এতটাই জটিল যে সমস্ত রাস্তা জলের তলায়, দূরবর্তী, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছনোর আর কোনও উপায় নেই। উল্লেখ্য, কেরলের এই বন্যায় সবথেকে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম এই চেঙ্গানুর। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়েছিল, ১৭-১৮ অগাস্ট নাগাদ একটা সময় ট্যুইটারে ট্রেন্ডিং হয়ে উঠেছিল চেঙ্গানুরের কথা। সেখানকার বিধায়ক নিজে জানিয়েছিলেন, দ্রুত উদ্ধারকারীরা না পৌঁছলে জলে ডুবে মৃত্যু হতে পারে প্রায় ১০ হাজার মানুষের। প্রথম অবস্থায় কেরল প্রশাসন চেঙ্গানুরের এই পরিস্থিতির কথা জানতেই পারেনি। মেজর হেমন্ত রাজ নিজেও সে কথা উল্লেখ করেছেন। পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবর প্রচার হওয়ার পর উদ্ধারকারী দলকে পাঠানো হয় সেখানে।

চেঙ্গানুরে যেখানে অবতরণ করেন হেমন্ত রাজ, সেখানে কাছেই একটি কলেজে ত্রাণ শিবির তৈরি করা হয়েছিল। এই ত্রাণ শিবিরেই ‘কমান্ড সেন্টার’ তৈরি করা হয়। প্রাক্তন কিছু সেনা কর্মী ও পড়ুয়াদের নিয়ে একটি টিম গঠন করেন তিনি। পরে জানতে পারেন ওই এলাকায় উদ্ধারকার্যে এসেছে ভারতীয় সেনার গাড়োওয়াল রাইফেলসের ১৩ টি দল। কিন্তু ভাষাগত কারণে স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগে ও বন্যা দুর্গতদের সঙ্গে কথোপকোথনে তাঁদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল। তাঁদের সাহায্যার্থে নিজের টিম থেকে ১৩ জন প্রাক্তন সেনাকর্মীকে পাঠান হেমন্ত। স্থানীয় মৎস্যজীবীরাও এগিয়ে আসেন তাঁদের সাহায্যার্থে।
এরপর হেমন্ত রাজ তাঁর দল নিয়ে রওনা হন চেঙ্গানুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উদ্ধারকার্যের জন্য। তাঁর দলে ছিলেন ৩৫ জন প্রাক্তন সেনা কর্মী ও বেশ কিছু পড়ুয়া। একে একে উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা হয় মহিলা, শিশুদের। হেমন্ত জানিয়েছেন, পড়ুয়ারা নিজেদের ল্যাপটপ ও মোবাইলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ফোনে চার্জ দেওয়া যাচ্ছিল না। এরপর তাঁরা যোগাযোগ করেন স্থানীয় এফএম চ্যানেলের উপস্থাপক ও বিশিষ্ট গায়িকা উষা উত্থুপের মেয়ে অঞ্জলী উত্থুপের সঙ্গে, যাতে তিনি তাঁর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানান ওই এলাকায় পাওয়ার ব্যাঙ্ক ও হাই পাওয়ার বোট পাঠানোর জন্য। কাজ হয় তাতে। প্রশাসনের তরফে পাঠানো হয় পাওয়ার ব্যাঙ্ক ও হাই পাওয়ার বোট। যেগুলির মাধ্যমে এলাকার শতশত মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে পেরেছেন হেমন্ত রাজ ও তাঁর টিম। তিন দিনে, প্রতিদিন ১০ টন করে খাদ্য সামগ্রী বন্যা দুর্গতের কাছে পোঁছে দিয়েছে তাঁর এই দল।
এরই মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় মেজর হেমন্ত রাজ ও তাঁর টিমের এই উদ্ধারকার্যের ছবি। যা দেখে হেমন্তের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁর স্ত্রী তীর্থা। জানান, ছেলে আয়ান ও অভিভাবকদের সঙ্গে তাঁরা রয়েছেন আরও এক বন্যা প্লাবিত শহর কোট্টায়নের একটি ত্রাণ শিবিরে। মেজর জানিয়েছেন, উদ্ধারকার্য প্রায় শেষ, বন্যা পরিস্থিতিও এখন নিয়ন্ত্রণে। এবার তিনি খুব দ্রুত তাঁর পরিবার, স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চান। তাঁর কথায়, ‘এই ধ্বংসের পরিমাণ, অভিঘাত বিপুল। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমরা এটাকে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব।’
বিগত এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই বন্যার ছোবলে এখন কার্যত লণ্ডভণ্ড বলা চলে কেরলকে। চলছে মেরামতি, উদ্ধারকাজ, পুনর্বাসনের কাজ। সময় লাগবে হয়তো বেশ কিছু মাস, বেশ কিছু বছর। এসবের মাঝেই জীবনবোধের বীরত্বের এই সব আখ্যান নিয়েই আজীবন বেঁচে থাকবেন মেজর হেমন্ত রাজ ও তাঁর টিমের সদস্যরা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই লড়াইয়ের বেশ কিছু ঘটনা ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে, হয়তো আরও বেশ কিছু ঘটনা সামনে আসবে, যা এই বিপন্ন সমাজেও বার্তা দিয়ে যাবে মানবিকতার, জীবনবোধের।

Comments are closed.