স্মরণে মিলনদা

‘আমি কী হেরিলাম মিলনেতে গিয়ে সজনী গো / কী হেরিলাম মিলনেতে গিয়ে / হেরি নব চান্দে পড়িলাম ফান্দে / আমার রিসার্চ না হ‌ইল / কুলে কালি র‌ইলো…’
এমন‌ই সরস ও জনপ্রিয় গান আলাপন ক্যান্টিনের কর্ণধার মিলনদাকে কেন্দ্র করে আট ও নয়ের দশকের যদুবংশীয় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ‘ক্যাম্পাসে এসে মিলনদায় চলে আসিস’-টা আজ আর কোনও অজানা ডাক নয় যাদবপুরে।

ছাত্রদের ভালোবাসতে ও শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতে জানতেন মিলন কান্তি দে। শারীরবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পরিমল দেবনাথের রোজনামচা ছিল ভোরবেলায় এখানেই চা খেয়ে দিন শুরু করা। ছয়ের দশকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাখালদার ক্যান্টিনে শিক্ষকদের যাতায়াত বিশেষ ছিল না। যাদবপুরের মিলনদার ক্যান্টিন সেদিক থেকে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। গত চার দশক ধরে এটা আলাপনের বৈশিষ্ট্য। গতেবাঁধা শিক্ষা অর্জন না করলেও মিলনদার জ্ঞানপিপাসা এবং উৎসাহ ছিল অনিঃশেষ। প্রাক্তন উপাচার্য শ্রী অশোকনাথ বসুর স্মৃতিচারণায় জানা যায়, ‘ন্যাক’ সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে সম্যক ধারণা অর্জন করে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তারক্ষীদের সে সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন মিলনদাই।

আশু, তীর্থ, কৌশিক প্রমুখ বহু প্রাক্তন ছাত্রের কাছেই ‘মিলনদা’য় বসে এক শিক্ষকের কল্যাণে আনন্দবাজারের শব্দ ছকের সমাধান করা ছিল এক মজার অভিজ্ঞতা। মিলনদা তাঁর আচরণে ও ব্যবহারে ছিলেন প্রকৃত‌ই সাম্যবাদী। ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-বহিরাগতদের খাবার পরিবেশন করতেন সমান মনোযোগে। অ্যাডমিশনের কাউন্সেলিংয়ের দিনে বিপুল ভিড় সামলেও পারদর্শিতার সঙ্গে একপিস কোয়ার্টার পাউন্ড পাঁউরুটিতে মাখন লাগিয়ে একদিকে দেওয়া এবং জ্যাম লাগিয়ে অন্যদিকে দেওয়া ছিল তাঁর বাঁ-হাতের খেলা। রান্নায় আগ্রহী পিজি হোস্টেলের আবাসিক তথা প্রাক্তনী মিনহাজ হোসেনকে তিনিই চিকেন স্ট্যু বানাতে শিখিয়েছিলেন।
মেইন হোস্টেলে থাকা আবাসিকদের দশটা কুড়িতে প্রথম ক্লাসে ঢোকার আগে সোয়া দশটায় আলাপনে চা পান করা অথবা শিক্ষক সমিতির যে কোনও সভায় ১৫ কাপ চা, বিস্কুট এবং সিঙাড়ার যোগান ছিল বাঁধা। তিনি কাউকে পাঠিয়ে দিতেন, নয়তো বকুনি দিয়ে কাউকে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন। টাকা দিতে দেরি হলেও স্নেহবশতঃ কপট রাগ দেখাতেন কেবল। ফার্মাসি বিভাগের প্রবীর ওঝা ও তাঁর সাথীদের আড্ডার ঠেক, চায়ের নেশা না থাকা থেকে ‘গরম জলে’র প্রেমে পড়া, এসি ক্যান্টিনে আয়োজিত যে কোনও অনুষ্ঠানে মিলনদার ক্যান্টিনে প্রস্তুত পাবদা মাছ রসিয়ে খাওয়া ছিল ক্যাম্পাসজীবনের অন্যতম অঙ্গ। ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারীদের কাছে ঢপ থেকে চিকেন ললিপপ ছিল সারাদিনের অন্যতম রসদ। যাদবপুরের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে এই ক্যান্টিন।
শহিদ বেদী তৈরি করতে ভুলে গিয়ে অগত্যা শেষ মুহূর্তে মিলনদার থেকে বিসলারির কার্টন জোগাড় করা থেকে শুরু করে বহু ‘রেসকিউ মিশনে’ বর্তমান কলা ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক দেবরাজের কমরেড হয়ে থেকেছেন মিলনদা। পোস্টার মারতে গিয়ে আঠা শেষ হয়ে গেলে আঠা তৈরি করে দেওয়া এবং খিদেয় পেট-চুঁইচুঁই-করা খুদে কর্মীদের বিনা পয়সায় খাওয়ানো ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। সাতের দশকের শেষ এবং আটের দশকের শুরুতে গড়ফা-সন্তোষপুর অঞ্চলের বহু রাজনৈতিক কর্মী আলাপনে খেয়েছেন এবং আশ্রয় নিয়েছেন।
১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়ে প্রতিদিন মিলনদার ক্যান্টিনে আসা ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শ্রী পুরুষোত্তম ভট্টাচার্যের রুটিন। প্রথমে ছাত্র এবং পরে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়া সুগত হাজরাকে মিলনদা ‘অভিভাবকসুলভ‌‌ উপদেশ’ দিয়েছিলেন, বাইকে স‌‌ওয়ার হয়ে সানগ্লাস পরে ক্যাম্পাসে না আসতে। তাতে নাকি ‘আন্দোলন’ ব্যাহত হতে পারে!
কলা ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রনীল মজুমদারের আলাপন ক্যান্টিনে প্রয়াত প্রাক্তন অধ্যাপক জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খপ্পরে পড়ে ‘অসহায়’ভাবে স্যরের গল্প শুনে যাওয়ার থেকে চায়ের পর ‘ওই একটা’ নিষিদ্ধ কাজের নেশায় আসক্ত হ‌ওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মিলনদা।

তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কাছে মিলনকাকা অথবা জ্যাঠা ছিলেন স্নেহের প্রতিমূর্তি। এই মানুষটির কাঁটাতার পেরিয়ে, সব কিছু হারিয়ে, সংগ্রাম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা দৃষ্টান্ত হিসেবে অমলিন থাকবেন ।

(ছবি সৌজন্যে কৌশিক আনন্দ কীর্তনিয়া এবং উত্তীয় বসু)

Leave A Reply

Your email address will not be published.