লকডাউনের ৩ মাসে আনন্দবাজার, হিন্দু, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সহ দেশের কোন সংবাদপত্রে কত ছাঁটাই? সত্যিই কি মিডিয়া সংকটে, নাকি পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে মালিক পক্ষ?
২৪ মার্চ, ২০২০। লকডাউন ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পাশাপাশি জানালেন, কর্মী ছাঁটাই বা বেতনে কোপ চলবে না। বেশ কয়েক দফায় লকডাউনের পর ভারত প্রবেশ করেছে আনলকে। কিন্তু দেশজুড়ে দেদারে চলছে ছাঁটাই, বেতনে পড়ছে কোপ। সামগ্রিক এই অবস্থার অন্যতম বড় শিকার হয়েছে দেশের সংবাদমাধ্যম। বিশেষ করে সংবাদপত্র।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় মে মাসের শেষ থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ছাঁটাই হয়েছেন প্রায় ৩৫০ জন কর্মী, এই সময় পত্রিকায় অন্তত ৯ জন। এর সঙ্গে বেতন কমেছে প্রায় সর্বত্র। কিন্তু সংবাদমাধ্যম, বিশেষত বড় সংবাদপত্রের কী অবস্থা গোটা দেশে?
মার্চের শেষ থেকে জুনের শেষ, তিন মাসে একের পর এক সংবাদমাধ্যমের ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে। বেতন কমেছে হাজার হাজার সংবাদকর্মীর। বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে প্রচুর লোককে। চলছে বিপুল ছাঁটাই। প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কি এত খারাপ অবস্থা সংবাদমাধ্যমের অর্থনীতির? নাকি সামগ্রিক অর্থনৈতিক দোলাচলের সুযোগ নিয়ে চলছে ছাঁটাই ও বেতন কমানোর প্রক্রিয়া? করোনা পরবর্তী সময় ভারতে সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ কি সত্যিই নড়বড়ে হয়ে পড়ল?
আরও জানতে ক্লিক করুন: ফের ছাঁটাই হিন্দু ও আনন্দবাজারে, বেনজির সংকটে খবরের কাগজ শিল্প
সঠিক কারণ এখনও জল্পনার গর্ভে, কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কীভাবে চলছে ভারতের মিডিয়া, তার একটি আর্কাইভ তৈরি করেছেন দিল্লির সাংবাদিক সিরিল স্যাম। তা প্রকাশিত হয়েছে Medium ওয়েবে। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর লকডাউন ঘোষণার পর থেকে সাম্প্রতিক সময় (২৩ জুন) অবধি দেশের সংবাদমাধ্যমে কী কী চলেছে, তার একটি ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, গত ৩ মাসে ভারতের সাংবাদিকদের কী কী দেখতে হয়েছে।
২৩ জুন, ২০২০
১. এই দিন থেকে ছাঁটাই শুরু করে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। ফিচার এবং অপ এড বিভাগে কর্মরত কম পক্ষে ৪ জন সাংবাদিককে মৌখিকভাবে ইস্তফা দিয়ে বলা হয়। প্রধান সম্পাদক রাজকমল ঝা এবং এক্সিকিউটিভ এডিটর উন্নিরাজন শঙ্করের বেতন কমেছে, কাজের ক্ষেত্রে বদল এসেছে। জানা গিয়েছে, ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা ২ মাসের বেতন পাবেন। যদিও কোনও কিছুই লিখিত নথিতে নেই। আগামী দিনে আরও ছাঁটাইয়ের পথ প্রস্তুত বলে মনে করছেন সিরিল স্যাম।
২. বন্ধ হয়ে গেল হিন্দি ভাষার ক্রিকেট সম্রাট ম্যাগাজিন। ১৯৭৮ সালে ম্যাগাজিনটি শুরু করেছিলেন আনন্দ দেওয়ান।
২২ জুন, ২০২০
দ্য হিন্দু সংবাদপত্র মুম্বই সংস্করণের সমস্ত কর্মীকে ইস্তফা দিতে বলে। একইদিনে প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া দ্য হিন্দুর সম্পাদককে নোটিস পাঠায়। তাতে কর্মীদের ছাঁটাইয়ের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। জানা গিয়েছে, কর্ণাটকের ৯ জন, তেলেঙ্গানার ৬ জন, কলকাতার ২ জন, মুম্বইয়ের ২০ জনকে ফোন করে জানানো হয়েছিল, ইস্তফা দিন, না হলে ছাঁটাই করা হবে।
২১ জুন, ২০২০
ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি বা EPW কর্মীদের পাঠানো ই-মেলে ঘোষণা করে, সকলের বেতন কমানো হচ্ছে। ই-মেলে সই ছিল EPW র এডিটর গোপাল গুরুর। অগাস্টে ফের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে বলে জানানো হয়।
১৭ জুন, ২০২০
ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের মালিক অরুণ পুরি ইন্টারনাল ই-মেলে কর্মীদের জানান, এই মাস থেকেই বেতন কমানো ও ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
৩১ মে, ২০২০
দ্য টেলিগ্রাফ ঝাড়খণ্ড ও নর্থ ইস্ট এডিশন বন্ধ করার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে।
আরও জানতে ক্লিক করুন: এই সময়, আজকালেও কমল বেতন, বাদ গেল না আনন্দবাজার পত্রিকাও
২৬ মে, ২০২০
ABP ডিজিটাল থেকে চাকরি যায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের।
১২ মে, ২০২০
ক্যারাভ্যান ম্যাগাজিন আগামী ৪ মাস ধরে কর্মীদের বেতন কমানোর কথা ঘোষণা করে।
১০ মে, ২০২০
আনন্দবাজার পত্রিকা ইন্টারনাল ই-মেলে জানায় দিল্লি, বেঙ্গালুরু, নয়ডা, চেন্নাই ও হায়দরাবাদের ভাড়া নেওয়া অফিস ফাঁকা করে দেওয়া হচ্ছে।
৩০ এপ্রিল, ২০২০
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কর্মীদের অভ্যন্তরীণ ই-মেলের মাধ্যমে জানায়, এপ্রিলের বেতন পেতে দেরি হবে।
২৮ এপ্রিল, ২০২০
ফরচুন ইন্ডিয়া গোটা এডিটোরিয়াল টিমকে বেতন ছাড়া ৩ মাসের ছুটিতে পাঠায়। এডিটোরিয়াল টিমে মোট ২০ জন ছিলেন।
২৫ এপ্রিল, ২০২০
দ্য হিন্দু বেতন কমানোর কথা ঘোষণা করে।
দেশের প্রথম সারির কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে ঘটা বেতন সঙ্কোচন এবং ছাঁটাইয়ের কিছু তথ্য তুলে ধরা হল। সাংবাদিক সিরিল স্যাম তাঁর আর্কাইভে যেমন সংবাদমাধ্যমে ছাঁটাই বা বেতন কমানোর নির্দেশিকার কথা নথিভুক্ত করেছেন, তেমনই এই আর্কাইভে রয়েছে বেতন সঙ্কোচন এবং ছাঁটাই নিয়ে আদালতে যাওয়ার ঘটনাও। লাগাতার ছাঁটাই ও বেতন কমানোর অভিযোগ তুলে বম্বে হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট, একের পর এক মামলা হয়েছে। কোনও মামলাতে কেন্দ্র, রাজ্য সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছে জবাবদিহি তলব করেছে আদালত, আবার কোথাও ব্যবসা চালু রাখতে ছাঁটাই করা ছাড়া উপায় নেই বলে জানিয়েছে মালিক পক্ষ।
আরও জানতে ক্লিক করুন: কেন ইস্তফা দিলেন আনন্দবাজারের সম্পাদক অনির্বাণ চ্যাটার্জি?
এই ডামাডোলের মধ্যেও একটি বিষয় স্পষ্ট নয়, ভারতের সংবাদমাধ্যমের আর্থিক স্বাস্থ্য কি সত্যিই এত দুর্বল যে, দু’মাস বিজ্ঞাপনে কোপ পড়লে সংস্থা বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হয়? নাকি বৃহত্তর পরিবর্তনের অঙ্গ হিসেবেই চলছে ব্যয় সঙ্কোচন? তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, দেশে সংবাদমাধ্যমের সার্বিক ছাঁটাই এবং বেতনে কোপের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খবরের কাগজে কাজ করা কর্মীরা। টিভি নিউজ কিংবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিউজ করা সংস্থাগুলোতে যে একেবারেই ছাঁটাই কিংবা বেতনে কোপ পড়েনি তা হয়ত নয়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রভাব খবরের কাগজেই।
যে কারণে করোনা এবং লকডাউন পরবর্তী ভারতবর্ষে আজ প্রশ্নের মুখে সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ! ডিজিটাল সভ্যতার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সংবাদপত্র ব্যবসা কি ক্রমেই অলাভজনক বলে প্রমাণিত হওয়ার পথে? প্রশ্নগুলো উঠছে, উত্তর অজানা!
Comments are closed.