প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনায় কমছে কৃষকের সংখ্যা, অথচ রিলায়েন্স, এসারের মতো বিমা সংস্থাগুলির মুনাফা বাড়ছে কীভাবে

প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা। সরকারি এই বিমা প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাংবাদিক পি সাইনাথ। বলেছিলেন, রাফালের থেকেও বড় দুর্নীতি হচ্ছে এই প্রকল্পে, রিলায়েন্সের কোটি কোটি টাকার মুনাফা হচ্ছে। এবার সরকারি রিপোর্টেও উঠে এল এক অদ্ভুত তথ্য। এই প্রকল্পে দিন দিন উপভোক্তার সংখ্যা কমলেও, বিমা কোম্পানিগুলির লাভের হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কমছে উপভোক্তা, বাড়ছে লাভ!
২০১৮-১৯ খারিফ (মূলত গ্রীষ্ম) মরসুমে মোদী সরকারের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’য় কৃষক উপভোক্তার সংখ্যা কমে হয়েছে ৩৪৩ লক্ষ। এই তথ্য জানা গিয়েছে, ২৫ ও ২৬ এপ্রিল দিল্লিতে আয়োজিত কৃষি মন্ত্রকের বার্ষিক খারিফ কনফারেন্সে। ২০১৬ সালে যখন ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকল্পটি চালু করা হয়, তখন এতে যুক্ত হয়েছিলেন দেশের ৪০৪ লক্ষ কৃষক। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা কমে হয় ৩৪৯ লক্ষ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, অংশগ্রহণকারী কৃষকের সংখ্যা বছর বছর কমলেও বিমা কোম্পানিগুলির লাভ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ফসল বিমা যোজনা করিয়ে রিলায়েন্স কিংবা এসারের মতো বিমা সংস্থাগুলো ২০১৬ সালে লাভ করেছিল ১৬,০১৫ কোটি টাকা অথচ ২০১৮ সালে, কৃষক সংখ্যা কমলেও, লাভের অঙ্ক লাফিয়ে বেড়ে হয়েছে ২০,৫২২ কোটি টাকা!
ফসল বিমার নেপথ্যে…
উপভোক্তার সংখ্যা কমলেও কীভাবে বেড়ে চলেছে সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থাগুলির লাভ? কৃষক সংখ্যা যে হারে কমছে ঠিক সেই হারেই বাড়ছে কৃষকদের বিমার কিস্তির পরিমাণ। সেই অনুপাতেই বৃদ্ধি হচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্যের অনুদানেও। অর্থাৎ, কৃষকের পরিমাণ যত কমবে, ততই বাড়বে বিমা সংস্থার লাভ। এর ফলে ১ টাকাও খরচ না করে সংস্থার ঘরে ঢুকছে হাজার কোটি টাকা।
কৃষকরা মুখ ফেরাচ্ছেন কেন?
কখনও অতিবৃষ্টি আবার কখনও খরা, কৃষি প্রধান দেশে বিভিন্ন কারণে ফসল নষ্ট হয়। কৃষকদের অভিজ্ঞতা, ফসলে বিমা করা থাকলেও সেই টাকা পেতে কালঘাম ছোটে তাদের। সরকারি লাল ফিতের ফাঁস কাটিয়ে বিমার টাকা কৃষকের হাতে আসতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেরিয়ে যায় মরসুম। ফলে স্বভাবতই ক্ষতি পূরণ হয় না। পাশাপাশি রয়েছে ক্ষতির তুলনায় নগণ্য অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া। এক্ষেত্রেও কৃষকদের বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। ফলে বিমা করা থাকলেও প্রথমত বিমার টাকা পেতে দেরি হয়, পাশাপাশি বিমার টাকা পেলেও তা হয় ক্ষতির তুলনায় নগন্য। স্বভাবতই সরকারি বিমা যোজনায় আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা। গত বছর দেশে ৯ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। কিন্তু গুজরাত, কর্ণাটকের উত্তরাংশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্রের মারাঠাওয়াড়া এবং পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যথেষ্টই কম। তার সরাসরি প্রভাব পড়ে এই বিশাল এলাকার কৃষি ফলনে। কিন্তু গত বছর সরকারি ফসল বিমা নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা কৃষকদের বিশাল একটি অংশকে এবার বিমা থেকে দূরে রেখেছে।
ফসল বিমা যোজনায় কৃষক অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা কমার অর্থ, সেই কৃষকরা ফিরে যাচ্ছেন প্রকৃতির ভরসায়। এক্ষেত্রেও ফসল নষ্ট হলে সরকারের দরজায় টোকা মারা ছাড়া উপায় থাকে না গরিব কৃষকের।
মুনাফাই মুনাফা!
নয়াদিল্লির কনফারেন্সেই প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার সিইও আশিস ভুতানির কথায় উঠে আসে এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তিনি বলেন, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ সালে বিমা কোম্পানিগুলো কেবল উদ্বৃত্ত হিসেবে পকেটে পুরেছে ১০,২১৯ কোটি টাকা। এই দুই আর্থিক বছরে বিমা সংস্থাগুলো কিস্তি বা প্রিমিয়াম বাবদ সংগ্রহ করেছে ৪৭,৪৪৭ কোটি টাকা। আর চারটি শস্য মরসুমে (একটি করে খারিফ এবং রবি মিলিয়ে বছরে দুটো) তাদের কৃষকদের বিমা বাবদ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ৩৭,২২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ নেট মুনাফা ১০,২১৯ কোটি টাকা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার মাধ্যমে ঠিক কারা উপকৃত হচ্ছেন? কৃষকরা নাকি রিলায়েন্সের মতো বিমা সংস্থাগুলো?

Comments are closed.