প্রসেনজিৎ: ইরফান, ঋষি কাপুর, পরিবারের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে হারালাম, আর কত স্বজন হারানোর খবর পেতে হবে আমাদের
রেশমি বাগচি: বুম্বাদা কেমন আছো তুমি? একের পর এক প্রিয় মানুষের চলে যাওয়ার খবর, দেশজুড়ে ভাইরাস আতঙ্ক,সব মিলিয়ে কেমন আছো?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: আছি একরকম রেশমি। খুবই দুঃখজনক খবর পেলাম পর পর দু’দিন। দু’জন দক্ষ অভিনেতা এবং ভালো মনের মানুষকে হারালাম। ইরফানের শেষ অভিনীত ফিল্ম, আংরেজি মিডিয়াম এই ঘরবন্দি অবস্থাতেই দেখলাম। ভাবছিলাম ওই শারীরিক অবস্থাতেও কী অসাধারণ অভিনয়ের নিদর্শন রেখে গেল ইরফান।
ঋষি কাপুরের কথা আমি আমার বইতেও অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছি, উনি বারবার প্রমাণ করেছেন কী অসামান্য পারফর্মার এবং অভিনেতা ছিলেন তিনি। একটা যুগ শেষ হল যেন।
একটা প্রতিষ্ঠান ছিলেন ঋষি কাপুর। শুরু করেছিলেন লাভার বয় ইমেজ দিয়ে, কিন্তু তারপর যখন বিরতির পর ফিরে এলেন, তখন নিজেকে দিয়ে কতরকম কাজ করিয়ে নিলেন। অগ্নিপথ থেকে শুরু করে কাপুর অ্যান্ড সন্স, কখনও নেগেটিভ চরিত্র, কখনও দাদুর চরিত্রে। আমার মত যাঁরা রোমান্টিক হিরো হিসেবে শুরু করেছিল, তাঁদের কাছে উনি পথপ্রদর্শক। আমাকে উনি ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন নানারকম চরিত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ক্ষেত্রে। আমার পরিবারের দু’জন খুব গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে হারালাম।
রেশমি বাগচি: ভয় বা অনিশ্চয়তার অনুভূতি কি চেপে বসছে মনে?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: দেখো ভয়ের অনুভূতির চেয়ে বেশি অনিশ্চয়তার চাপ অনুভব করছি। কারণ আমরা কেউই ঠিক বুঝতে পারছি না, কবে সব কিছু ঠিক হবে, আর কত স্বজন হারানোর খবর পেতে হবে আমাদের। তাই নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনাও করে উঠতে পারছি না। মনের ভেতরে ভাবনা চিন্তার ঠিক কোনও কূল-কিনারা করতে পারছি না এখনও রেশমি। আর পাঁচজনের মতো আমারও চিন্তা হচ্ছে, টেনশন হচ্ছে। কিন্তু শুধু চিন্তা করে কী হবে, আমাদের নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে লড়াই এর জন্য।
রেশমি বাগচি: তুমি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার দিকে শুধু ইন্ডাস্ট্রি না, সকলেই তাকিয়ে থাকে, সমাধানের আশায়!
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: শুধুমাত্র এই ইন্ডাস্ট্রি না, সবরকম পারফর্মিং আর্টসের ক্ষেত্রেই সময়টা খুবই কঠিন, আগামী দিনে আরও বড় লড়াই আছে।
তবে একটা বিষয় আমরা নিশ্চিত, এই দুর্দিনে আমরা একে অপরের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছি, আমরা শুধু নিজে বা পরিবারের কথা ভেবে আইসোলেশনে আছি তা নয়, আমরা দেশের প্রত্যেকটি মানুষের জন্য ভাবছি। এই একতাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।
এই সমস্যা থেকে বেরোতে আমাদের হবেই, আর সবাই একসাথে হলে, তা আমরা পারবো, পারতে আমাদের হবেই।
রেশমি বাগচি: এই ক্রাইসিস কি আমাদের আরও বেশি মানবিক করে তুলবে?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: আমার মনে হয় অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত অর্থে লকডাউনের কারণ বুঝেছেন এবং পালন করছেন। এই সময়ের কথা পৃথিবীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। একদিকে চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের সব বিভাগের কর্মী থেকে পুলিশ, জরুরি পরিষেবা যাঁরা দিচ্ছেন, সবাই আমাদের জন্যই কাজ করছেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। আর আমরাও কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করছি বাড়িতে থেকে। যাঁরা বুঝতে পারছেন না, খুবই দুঃখজনক, হয়ত আমরা তাঁদের বোঝাতে পারছি না। আমি তাঁদের অনুরোধ করব, দয়া করে বাড়িতে থাকুন, নিয়ম মেনে চলুন। আমার ধারণা এই ক্রাইসিসে পড়ে আমরা সবাই বুঝেছি, প্রকৃতির ক্ষমতার কাছে, আমরা কেউই কিছু না। মানুষের ভেতরের ভালোত্ব অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে আমার মতে।
রেশমি বাগচি: ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে বুম্বাদা?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: শুধু তো ইন্ডাস্ট্রি না, তার সাথে আরও অনেকে জড়িয়ে। যেমন ধরো যিনি হলের সামনে চা বিক্রি করেন বা খাবারের দোকান। এটা একটা চেনের মতো। সবার ওপর প্রভাব পড়বে। ঘুরে তো আমরা দাঁড়াবোই। আমার যা ক্যালকুলেশন, এখন সবচেয়ে বেশি দরকার ধৈর্য।
তাড়াহুড়ো করলে হবে না, ধৈর্য ধরে একটু একটু করে এগোতে হবে। ইনফ্যাক্ট আমি বলব, যে পেশাতেই থাকুন না কেন, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি, এই সময়টা ভুলে যান। আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে, সেটা যত তাড়াতাড়ি বুঝব ততই ভালো, নাহলে সাংঘাতিক মানসিক চাপে পড়ে যাবো সবাই।
রেশমি বাগচি: ক্ষতির অঙ্ক অনেক হবে বলাই বাহুল্য। সেটা সামাল দিতে গিয়ে অনেক মানুষের কাজ হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে..
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ক্ষতির অঙ্ক নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। তোমরা জানো, যে কাজটা আমরা করি, সেটা করতেও অনেক মানুষ লাগে, সমষ্টিগত কাজ। আবার কাজটা দেখেনও অনেক মানুষ! একসাথে হয়ে, এক ছাদের নীচে জড়ো হয়ে। তাই বুঝতেই পারা যায়, ঠিকঠাক চলবে না। লাভ কম হবে, কিন্তু সেটাই সবাইকে দিয়ে নিজেরটুকু নিতে হবে। আগে ১০ হত, এখন হয়ত ৫ হবে, ৪ হবে। লাভ কম থাকুক, চালিয়ে নেব ঠিক। আবারও বলছি, ধৈর্য ধরলে একটু একটু করে ধাক্কা সামলানো যাবে।
রেশমি বাগচি: মানুষকে আবার হলে ফিরিয়ে আনতে হলে খুব যথাযথ পরিকল্পনা দরকার, এই নিয়ে তোমার কী ভাবনা?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: মানুষ হলে ফিরবেন। ভয়টা কাটাতে হবে। আমিই ভয় পাচ্ছি, দর্শকদের আর কী বলব। আস্তে-আস্তে কেটে যাবে। একটু সময় দিতে হবে।
রেশমি বাগচি: তবে ডিজিটাল মিডিয়াই যে ভবিষ্যৎ সেটা বলার সময় বোধহয় এসে গেছে…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: এরই মধ্যে অন্যান্য রিজিওনে যাঁরা বড় পরিচালক, তাঁরা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ফিল্ম রিলিজ করছেন। আমাদেরও চ্যানেলের সাথে বসে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সাথে কথা বলে এগোতে হবে, ভাবনা চিন্তা করতে হবে। খবর পেলাম অক্ষয় কুমার ওর একটা বড় ফিল্মের ব্যাপারে ডিল করল। হিন্দি, তেলেগু,তামিল ফিল্ম ইতিমধ্যেই করতে শুরু করে দিয়েছে, আমাদেরও করতে হবে। এখন আর কে বড়, কে ছোট এসব দেখলে হবে না। ব্যক্তিগত জায়গাটা সরিয়ে এখন সবাই মিলে আগে বাঁচতে হবে।
রেশমি বাগচি: দুটো শর্ট ফিল্ম করলে তুমি, একটা জাতীয় স্তরে আর অন্যটা আঞ্চলিক, কেমন লাগল?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: আমরা ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একটা পরিবার হলে অভিতাভ বচ্চন মহীরুহর মতন । তিনি সব রিজিওনের অভিনেতাকে একসাথে করে যে কনসেপ্ট ভেবেছিলেন আমাদের নিয়ে, তাতে আমরা খুবই গর্বিত। সবটাই বাড়িতে বসে করলাম। তারপর ‘ঝড় থেমে যাবে’তেও অরিন্দম এত ভালো করেছে! মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় আমরা সকলে মিলে বড় অর্থ সংগ্রহ করতে পেরেছি। পরিবারের অনেক সদস্য তাতে লাভবান হয়েছে।
রেশমি বাগচি: স্ক্রিপ্ট পড়া চলছে তোমার? অনেকটা সময় পেয়েছ যেহেতু…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: স্ক্রিপ্টের কাজ বেশ ভালোই চলছে। অনেকদিন একটি উপন্যাস নিয়ে কাজ করার কথা ছিল, সেটির স্ক্রিপ্ট হয়ে গেছে। বার বার করে পড়া, কারেকশন, যা আগে সামনে বসে করতাম তাই এখন, ভিডিও কলে করছি। যেহেতু সময় পেয়েছি, কত স্মৃতি, কত ছবি, হাতে পড়ছে, দেখছি, গুছিয়ে রাখছি। আমার যে কোর টিম, তার মধ্যে আমার বোন পল্লবী, মোহর, অ্যাকাউন্টস টিম, সবাই আমার সাথে সারাক্ষণ যোগাযোগ রাখছে। পরবর্তী কাজ নিয়ে ভাবনা চলছে।
রেশমি বাগচি: তোমরা তিনজনেই বাড়িতে, সেটা নিঃসন্দেহে বড় পাওনা…
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, তিনজনেই বাড়িতে, কিন্তু সময়টা এমন যে রিল্যাক্স করা, বা সেলিব্রেট করার মতো মানসিকতা কারওর নেই। কথা বলছি, ছেলে হয়ত আমার সাথে ওয়ার্ক আউটও করছে, কিন্তু মন ভালো নেই কারওর।
রেশমি বাগচি: অভিভাবকের জায়গা থেকে যদি বলো, এরপর তো বাবা মায়েরা সন্তানদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠাতেও ভয় পাবে… তৃষাণজিৎকে নিয়েও তোমরা ভাববে?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: সন্তান যেখানেই থাকুক না কেন, বাবা মায়েদের কাছে খুবই কঠিন সময়। আমার খারাপ লাগছে বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে। ছুটি মানে তখন ওরা নিজের মত থাকবে। এখন ওরা বাড়িতে আছে, অনলাইন ক্লাস চলছে। যতই আমরা এটা করো,ওটা করো করছি, বুঝতে হবে ওরা তো এভাবে পড়াশোনা করতে অভ্যস্ত না। একটা স্বাধীনতা লাগে, যেটা স্কুলে পায় বাচ্চারা। তৃষানজিৎকে নিয়েও আমরা বাকি বাবা-মায়ের মতই চিন্তিত। এখন তো যা পরিস্থিতি হল, তাতে বাইরে থাকুক বা বাড়ির কাছে সবই এক।
রেশমি বাগচি: জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই কখনও করতে হয়নি আমাদের অনেককেই। কী বলবে সবাইকে….
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: এটা সবসময়ের জন্য প্রযোজ্য। যখন থেকে আমরা পেশাগত জীবনে এসেছি, তখন থেকেই এটা চরম সত্যি। টিকে থাকার লড়াই চলছে। তবে হ্যাঁ, আমাদের অতিরিক্ত চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে, যেন পাশের মানুষটাকে একটু সাহায্য করা যায়। তবেই সকলে বাঁচব ।
Comments are closed.