বসের কাছে অপমানিত হয়ে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গ্যারাজে ব্যবসা শুরু, খড়গপুর আইআইটির প্রাক্তনী রাজীব রায় আজ কোটিপতি শিল্পপতি
চাকরিতে অপমানিত হয়ে কাজে ইস্তফা দিয়েছিলেন, গ্যারাজে তৈরি করেছিলেন নিজের ফার্ম। কৃষিক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে আজ কোটিপতি শিল্পপতি আইআইটি খড়গপুরের প্রাক্তনী। রাজীব কুমার রায়ের অবিশ্বাস্য স্বপ্নপূরণের কাহিনি।
কৃষিক্ষেত্র ভারতের বৃহত্তম কর্মসংস্থানের জায়গা। যদিও, দেশের জিডিপির মাত্র ১৩.৫ শতাংশ আসে কৃষিক্ষেত্র, বনজ ও মৎস্য চাষের মাধ্যমে। দেশের কৃষিক্ষেত্রে এই যুগান্তকারী পরিবর্তনে কাজে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম রাজীব কুমার রায়।
পেশাগত জীবনে বারবার ঠোক্কর খেয়েও দেশ ও দশের কাজে লাগার তীব্র ইচ্ছে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার অদম্য জেদ নিয়ে রাজীবের লড়াই অনুপ্রেরণা দেবে বহু মানুষকে।
আইআইটি খড়্গপুরের প্রাক্তনী রাজীব বরাবরই দেশের কৃষিক্ষেত্রের আধুনীকিকরণ নিয়ে ভাবতেন। তাঁর সবসময় নজর ছিল, দেশের কৃষিক্ষেত্রকে এমন শক্তিশালী করে তুলতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কৃষকদের খালি পেটে না ঘুমোতে হয়। পাশাপাশি, কৃষিক্ষেত্রের সার্বিক বিকাশ করে দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এটাই ভাবাত আইআইটি খড়গপুরের এই প্রাক্তনীকে। তবে এই ভাবনা হয়ত বাস্তবায়িত হত না, যদি না অপমানিত হয়ে তিনি চাকরি ছাড়তেন।
ছাত্রাবস্থাতেই কৃষিক্ষেত্র নিয়ে এতটাই ভাবতেন রাজীব যে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বদলে বেছে নিয়েছিলেন এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এই বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চাপ একটা ছিল। কিন্তু বিহারের মধুবনীর বাসিন্দা রাজীবকুমার রায় বিশ্বাস করতেন, তিনি অন্যরকম কিছু একটা করবেনই।
আইআইটি খড়গপুর থেকে মাস্টার্স করার পর যে কোনও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মতো রাজীবের লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠিত সংস্থায় চাকরি করা।
কিন্তু কলেজ ক্যাম্পাসিং-এর দিন বোনের বিয়ের জন্য সেখানে থাকতে পারেননি রাজীব। বন্ধুরা সবাই ভালো ভালো সংস্থায় কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন। যদিও পরে চেষ্টা চরিত্র করে নিজের পছন্দের এক সংস্থাতে কাজ জোটাতে সক্ষম হন রাজীব। কিন্তু বেতন ছিল খুবই কম। তার উপর পোস্ট-হার্ভেস্টিং টেকনোলজিতে জ্ঞান নিয়ে প্রায় ন’মাস তাঁকে কাজ করতে হয় গ্রিনহাউস ভেঞ্চারে। এদিকে বেতনও বাড়ছিল না। চাকরি ছাড়ার কথা ভাবতে শুরু করেন রাজীব।
এরপর, চেন্নাইয়ে একটি সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে আবার বেতন সংক্রান্ত অসুবিধায় পড়েন তিনি। কয়েক মাসের পারিশ্রমিক আটকে আছে। কিন্তু নিজের অসুবিধার কথা বসের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ভীষণ অপমানিত হলেন রাজীব। অফিস থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, আর অন্যের নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ নয়। নিজে কিছু করবেন। ১৯৯৩ সালে পলিয়ন বরকাই ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি ইজরায়েলি সংস্থা, যা আগে তামিলনাড়ুর ওই সংস্থার সঙ্গে কাজ করত তারা রাজীবের মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিল। রাজীবকে ভারতে তাদের গ্রিনহাউস সংক্রান্ত কাজের প্রস্তাব দেয় ওই সংস্থা। কিন্তু রাজীবের বিপণনের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। তাতেও ওই সংস্থার আধিকারিকরা তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে, তাঁরা বিশ্বাস করেন রাজীব এই কাজ করতে যথেষ্ট সক্ষম। এর কিছুদিনের মধ্যে সেই সংস্থা জিনগার প্লাস্টিক প্রোডাক্টস লিমিটেড নামে আরেকটি ইজরায়েলি সংস্থার সঙ্গে হাত মেলায়। সেই সংযোজন পরবর্তী সময়ে রাজীবকেই জিনগার প্লাস্টিক প্রোডাক্টস লিমিটেডের ভারতীয় ডিরেক্টরের পদ দেওয়া হয়। কোম্পানির বিশ্বাসের পূর্ণ মর্যাদে দেন রাজীব রায়। তাঁর নেতৃত্বে ভারতে দারুণ সাফল্য পায় ওই সংস্থা।
কিন্তু জটিলতা যেন রাজীবের ঠিকানা খুঁজে নেয়। ২০০৩ সাল নাগাদ তাঁদের বিরুদ্ধে আমদানি সংক্রান্ত বেনিয়মের অভিযোগ আনে কিছু সংস্থা। ডিআরআই তদন্ত চালায় রাজীবের বাড়িতে। নিদ্রাহীন হয়ে রাতের পর রাত কাটান তিনি। তারপরই রাজীব কুমার রায়ের আসল পরিশ্রম শুরু। বলা যায়, একেবারে শূন্য থেকে শুরু। কিছু বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নিয়ে নিজেই আমদানি সংক্রান্ত ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তামিলনাড়ুর হোসুরে একটা ৮ ফুট বাই ১২ ফুটের গাড়ির গ্যারাজকে নিজের অফিস করেন রাজীব। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর নিজস্ব ব্যবসার পথ চলা। সংস্থার নাম দেন এগ্রিপ্লাস্ট। এই সংস্থার বিশেষত্ব হল কৃষিক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহারিক প্রয়োগ। এর মধ্যেই এগ্রিপ্লাস্ট প্রোটেক্টেড কাল্টিভেশন প্রাইভেট লিমিটেড নামে আরও এক সংস্থা তৈরি করেন তিনি। সুরক্ষিত কৃষিকাজের জন্য সম্পূর্ণ ব্যবস্থা প্রদান করে এই সংস্থাটি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া উদ্যোগের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, রাজীব সম্প্রতি আরও একটি সংস্থা তৈরি করেছেন যা ভারতে কৃষি সংক্রান্ত বিষয়ে অন্যতম অনলাইন ডিস্কোভারি প্ল্যাটফর্ম। এর উদ্দেশ্য হল, জ্ঞানের অভাব থাকা কৃষকদের সর্বোত্তম তথ্য ও প্রযুক্তি দিয়ে সজাগ করা এবং ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি। রাজীবের ৫৫ জনের একটি দল কাজ করে কৃষিতে প্রযুক্তি সংক্রান্ত কাজে, ৩০ জন কাজ করেন কৃষি সংরক্ষণ সংক্রান্ত কাজে। বাকি ৬ জন কর্মরত এগ্রিহাবে কাজ। বর্তমানে তিনটি ইজরায়েলি সংস্থা, দুটি ডাচ এবং ব্রিটেনের একটি সংস্থার সঙ্গে ব্যবসা করে রাজীব কুমার রায়ের সংস্থা। রাজীবের এগ্রিপ্লাস্ট টেক ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের বার্ষিক টার্নওভার ৫৫ কোটি কোটি টাকা। তাঁর এগ্রিপ্লাস্ট প্রোটেক্টেড কাল্টিভেশন প্রাইভেট লিমিটেডের বার্ষিক টার্নওভার ২০ কোটি টাকা। রাজীবের লক্ষ্য, ভারতে কৃষিক্ষেত্রে এবং কৃষকদের জন্য বিশ্বমানের প্রযুক্তির বন্দোবস্ত করে দেওয়া।
জীবন সফল হতে গেলে কী করবেন, এক সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নের জবাবে রাজীবকুমার রায়ের বার্তা, সাফল্যের কোনও শর্টকাট নেই। একজনকে শুধু নিজের প্রতিই নয়, দেশ ও জাতির কাছে সৎ হতে হবে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যম সর্বদা চেষ্টা করে যেতে হবে, আপনার পরিবার, বন্ধু বা আপনার দেশ থেকে যা পেয়েছেন তার বেশি তাদের ফেরত দেওয়া।
Comments are closed.