স্কুল, কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা আসলে রাষ্ট্রের নজরদারি নয় তো?

দৃশ্য ১, সময় বিকেল ৪টে, ১৯৯০ সালের জুলাই মাস
আশুতোষ কলেজের বাইরের রক। ৮–১০ ছাত্র-ছাত্রী বসে আছে। নির্ভেজাল আড্ডা চলছে। মাঝে মধ্যেই হাসির রোল উঠছে। হঠাৎ একজন এসে খবর দিল চল চল মিছিল আছে, অ্যাটেনডেন্স নিয়ে প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করতে হবে। সবাই হই হই করে বেরিয়ে পড়ল।
দৃশ্য ২, সময় বিকেল ৪টে, ২০১৯ সালের জুলাই মাস
আশুতোষ কলেজের বাইরের রক। ৮–১০ ছাত্র ছাত্রী বসে আছে। সবাই এক যোগে মাথা নীচু করে মোবাইল ফোন দেখছে বা বলা ভালো মোবাইল করছে। হঠাৎ একজন বলে উঠল, এই হোয়াটসঅ্যাপ করেছে অলোকদা, এখনই যেতে হবে। মিছিল আছে, প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করতে হবে। সবাই হই হই করে বেরিয়ে পড়ল।

আসলে সময়টা বদলে গেছে। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও যাঁরা স্কুল-কলেজে পড়তেন, তাঁদের চুলে আজ পাক ধরেছে। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন, সবার ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট আছে। তাঁদের ভালোলাগা, মন্দলাগা, লড়াই, আন্দোলন সমস্ত কিছুই ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু হয়। সরকারের বিপক্ষে কথা থেকে শুরু করে নিজেদের রাগের বহিঃপ্রকাশও আজকের প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়াতেই করে।
কেন্দ্রীয় সরকারের তাই এই নতুন প্রজন্মের দিকে নজর পড়েছে। তাঁরা একটা নতুন ব্যবস্থা আনতে চলেছে। দেশের প্রায় ৩ কোটি ছাত্র-ছাত্রী, যাঁরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছে। সরকারিভাবে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান এবং সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের ‘ভালো কাজের’ তাঁরা স্বীকৃতি দিতে চান। কেন্দ্রের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সেক্রেটারি আর সুব্রমনিয়াম একটি নির্দেশ জারি করেছেন, দেশের ৯০০ টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রায় ৪০ হাজার কলেজকে দ্রুত এই নির্দেশের আওতায় নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এখন অনেকে বলবেন হয়তো, এতে অসুবিধা কোথায়? সমস্ত কিছুই তো আজ প্রকাশ্যে, তাহলে এতে আর কী অসুবিধা? এমনিতেই তো সবাই জেনে যাচ্ছে সবার ব্যক্তিগত বিষয়, তাহলে দেশের সরকার যদি জানতে চায় তাহলে আপত্তি কেন উঠবে? আসলে এখানেই আসল প্রশ্ন। বেশ কিছু শিক্ষাবিদ এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যে, এর ফলে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর ওপর নজর রাখা হবে না তো? কেউ কেউ বলেছেন, যেহেতু অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁদের সরকার বিরোধী ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাহলে এই অ্যাকাউন্টগুলো থেকে কী কী ধরনের কথা লেখা হচ্ছে, সেদিকে নজর রাখাটাই কি সরকারের উদ্দেশ্য? আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে ফেসবুকের এবং তাঁর সহযোগী একটি সংস্থা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার একটা বড় ভুমিকা ছিল। সেই বিষয়ে পরে ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জুকেরবার্গকে প্রশ্ন করা হয় আমেরিকার আদালতে। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, আদালতে আসার আগে তিনি কোন হোটেলের কোন ঘরে ছিলেন, কী করেছিলেন? তিনি উত্তর দেন, তিনি জানাতে বাধ্য নন। বিচারক তাঁকে উল্টে বলেন ‘আপনি জানাতে বাধ্য নন, কিন্তু আপনি আশা করেন, আপনার সমস্ত গ্রাহক আপনাকে সমস্ত কিছু জানাবেন এবং সেই তথ্য জেনে আপনি তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করবেন?’ জুকেরবার্গ উত্তর দিতে পারেননি।
আসলে এটা নজরদারি রাষ্ট্রের দিকে আরও এক পা। সরকার খুব ভালো করে বোঝে, সমাজের কোন স্তর থেকে প্রতিবাদ উঠে আসতে পারে, কারা এই প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগঠিত করে। সুতরাং সেই জায়গাটাকেই সরকার অঙ্কুরে বিনাশ করতে চায়। যে চিঠিটা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেওয়া হয়েছে তাতে অবশ্য একটা মোড়ক আছে। বলা হয়েছে, এই নির্দেশিকার মধ্যে দিয়ে ‘সোশ্যাল মিডিয়া চ্যাম্পিয়ন’ বাছার কাজ করা হবে, এর ফলে প্রতিষ্ঠান এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দু’তরফেরই উপকার হবে। কিন্তু সত্যি কি তাই? নাকি সরকার সত্যজিৎ রায়ের ছবির সেই কথাকেই মনে করেছেন এবং প্রয়োগ করতে চাইছেন, ‘ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে’। তাই জানার যে জায়গা কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকেই নজরদারি শুরু করাটা আসল উদ্দেশ্য? লক্ষ্য রাখা হবে তাঁদের রাজনৈতিক চলনের দিকে, সেই ভিত্তিতে সরকারি সুযোগ সুবিধা বিলি বণ্টন করা হবে বা হবে না, সেটা ঠিক করা হবে। যদি ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার লেখা বা ছবির দিকে নজর রাখার ব্যবস্থা করা হয় সরকারিভাবে তাহলে কি এটা আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা নয়? আশঙ্কার কথা বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীই এই ফাঁদে পা দেবেন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকদেরও এই প্রক্রিয়াতে যুক্ত হতে বাধ্য হবেন। অনেকে এটাও বলা শুরু করেছেন যদি দায়বদ্ধতার প্রশ্নই হয় তাহলে শুধু ছাত্রদের কেন? সরকার চায় না কোনও বিরোধী কণ্ঠ উঠে আসুক তাই যে কোনও রকমভাবে এই বিরোধী কণ্ঠকে দমিয়ে রাখার জন্যই কি এই প্রক্রিয়া?
কিছু কিছু প্রশ্ন ছাত্র মহল থেকেও কিন্তু উঠে আসবে। যেমন, ‘অনুরোধ করা হচ্ছে’ বা ‘অনুমতি নেওয়া হচ্ছে’, এই শব্দগুলোর কিন্তু মানে জানতে চাওয়া হবে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন যদি চায় কিন্তু এটা নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে কথা চালু করতে পারে, যেখান থেকেই হয়তো আগামী দিনের নতুন লড়াইয়ের দিশা বেরোতে পারে।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.