করোনাভাইরাস নিয়ে Fake News -এর রমরমা, কীভাবে চিনবেন ফেক নিউজ?

লকডাউনের জেরে গৃহবন্দি জীবন কাটছে। সকলেই অপেক্ষা করছেন কত তাড়াতাড়ি এই মহামারি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। বাড়িতে বসে চোখ খবরের চ্যানেল আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হল করোনার চেয়েও দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে করোনা নিয়ে ভুয়ো খবর। এই fake news এর বাড়বাড়ন্ত এতটাই যে বাংলা সহ বিভিন্ন রাজ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন প্রচুর মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তবুও ফেক নিউজকে সম্পূর্ণ বশে আনা যায়নি।

 

করোনা নিয়ে ছড়ানো Fake News তথ্য

দিন কয়েক আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো এক পোস্টে বলা হয় ১৫ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিলের মধ্যে লকডাউন উঠে গেলেও, আবার ১০ এপ্রিল থেকে ১৮ মে পর্যন্ত লকডাউন থাকবে। আর সেই নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)! কিন্তু সত্যিটা হল, এমন কোনও প্রোটোকল নেই যাতে হু কোনও দেশকে লকডাউন নিয়ে নির্দেশ দিতে পারে।

করোনায় কাবু প্রিন্স চার্লস থেকে ব্রিটিশ প্রধানন্ত্রী বরিস জনসন সহ বিশ্বের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনেতা। এর মধ্যে গত শনিবার খবর ছড়ায়, পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের করোনা পজিটিভ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়ের গতিতে শেয়ার হতে শুরু করে এই খবর। ওই পোস্টে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানককের সঙ্গে জুড়ে যায় ইমরানের নামও।

কিন্তু পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এটি fake news বলে জানানো হয়।

করোনা প্রতিরোধে কী করবেন আর কী করবেন না, এমন নানা ভুল তথ্য হোয়াটস অ্যাপে ঘোরাফেরা করছে। কোথাও বলা হচ্ছে বেশি করে রসুন খেতে। আবার কাঁচা পেঁয়াজ খেলে করোনা সেরে যাবে এমন গুজবও হোয়াটসঅ্যাপের ছড়াচ্ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছেন মানুষ, তেমনি থাকছে কালোবাজারি বাড়ার আশঙ্কা৷ এর সঙ্গে আছে ইতালি, ইংল্যান্ডের করোনার ভয়াবহতার ফেক ভিডিও৷ আবার ভিন রাজ্যের পুরনো কোনও গণপিটুনির ছবিকে এখন সোশ্যাল ডিস্টান্সিং না মানার পরিণতি হিসেবে ফলাও প্রচার করছেন নেটিজেনদের একাংশ। সত্যাসত্য বিচার না করে সেগুলি দুমদাম শেয়ার করে ফেলছেন অনেকেই। এগুলো দেখলে মানসিক চাপ বাড়তে বাধ্য৷ তাই, এগুলো থেকে দূরে থাকুন।

 

এই গুজব অপপ্রচার রুখতে কী করবেন? (How to Stop Fake News Spread?)

সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও খবর পাওয়ার পর তা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করা বা শেয়ার করার আগে আমাদের কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত। ভিডিও বা পোস্টটি কতটা স্বচ্ছ, নেট জগতে ছড়িয়ে পড়লে তার পরিণাম কী হতে পারে তা ভাবুন।

কোনটা সংবাদ আর কোনটা মতামত, সেই পার্থক্য করা জরুরি। আমাদের মগজ প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে ভুল খবর ও মিথ্যে এবং সাজানো ছবিতে। আমরা সেটাই দেখি, সেটাই পড়ি যেটা আমরা দেখতে চাই, পড়তে চাই, শুনতে চাই। তাই আমি কী পড়বো, কাদের বন্ধু বানাবো, কাদের কথা বিশ্বাস করবো সে ব্যাপারে হুড়োহুড়ি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।

 

ফেক নিউজ বোঝার উপায় (How to Check Fake News?)

how to check fake news

 

হেডলাইন দেখেই আলটপকা মন্তব্য করে বসা বা শেয়ার করা।

সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিডে আসা খবরের শুধু হেডলাইন পড়েই শেয়ার করে দেন অনেকে। কেউ হয়ত প্রথম অনুচ্ছেদটা পড়েন। যারা নিজেদের স্বার্থে fake news ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তারা এই প্রবণতাকে খুব ভালো জানে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম অনুচ্ছেদে কিছু ভুয়ো তথ্য দিয়ে অথবা শিরোনামকে এমনভাবে প্রকাশ হয়, যাতে সত্যটা বোঝা যায় না। ফেক নিউজের ক্ষেত্রে যেটা বেশি দেখা যায় শিরোনামে যা লেখা আছে, তার সঙ্গে মূল খবরের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই কোনও খবর শেয়ার করার আগে পুরোটা পড়ুন। না পড়ে শেয়ার করে বসলে অন্য অনেকেই একইভাবে ভুল তথ্য জানবেন।

 

নিউজ সোর্স জানুন (Spot the Source of Fake News)

অচেনা ওয়েবসাইটের খবরকে সন্দেহ করাই স্বাভাবিকন। তাদের কোনও প্রতিবেদন, ভিডিও দেখে শেয়ার করার আগে সাইটে ঢুকে দেখে নিন সেটি কতদিনের পুরনো। কী ধরনের খবর সেখানে আগে প্রকাশ হয়েছে। সেইভাবে সংশ্লিষ্ট খবরটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য তার বিচার করুন।

 

শেয়ার হওয়া ভিডিও বা খবর পুরনো কিনা দেখুন

অনেক সময় পুরনো খবর সম্পূর্ণ অন্য ঘটনার প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই ভিডিও দেখে অনেকেই ভেবে বসেন সেটি বর্তমান সময়ের। বেশিরভাগ সময় আমরা সেই খবর প্রকাশের তারিখ বা সেই ভিডিওর সত্যাসত্য বিচার না করে শেয়ার করে দিই। সেদিকে সতর্ক নজর দেওয়া উচিত।

আবার এমনও হয়, একটি খবর সদ্য পোস্ট করা হয়েছে। কিন্তু তাতে যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, সেটি পুরনো। তাই পুরো খবরটি মন দিয়ে পড়া দরকার।

 

ভাইরাল খবরের লিঙ্ক দেখুন, তা অন্য কোথাও প্রকাশ হয়েছে কি?

বহু fake news portal বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের জন্য কিছু লিঙ্ক ও সূত্র দেয়। আপনি সেই সূত্র ও লিঙ্ক দেখে ভাবলেন, এসব যখন আছে, খবরটি ভুয়ো নয়। কিন্তু এই সব সূত্রগুলোও যাচাই করা দরকার। আদৌ সেখানে ঠিক তথ্য দেওয়া রয়েছে কিনা দেখে নিন।

 

ছবি, কোটেশন যাচাই

কোনও একটি ভিডিওতে বক্তা কোন প্রেক্ষিতে বলেছেন তার পুরো বক্তব্য না পেশ করে শুধুমাত্র ছোট একটি অংশ শেয়ার করে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। আবার কোন প্রেক্ষিতে কোনও বক্তা একটি মন্তব্য করেছেন, তা না দেখে ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁকে উদ্ধৃত করে তথ্যের বিকৃতি ঘটানো হয়।

সন্দেহজনক ছবির ক্ষেত্রে গুগুলে ছবি যাচাই করার সুযোগ আছে। ‘রিভার্স ইমেজ সার্চ’ করে, TinEye এর মতো টুলগুলি আপনাকে বলে দেবে ছবিটি আসলে কোথাকার।

 

পাঠক বা দর্শকের অনুভূতি কাজে লাগিয়ে তথ্য বিকৃতি

আমাদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বাস ভিন্ন। সেই অনুযায়ী আমরা খবরে নজর দিই, সেগুলোই শেয়ার করি। ভুয়ো খবরের কারবারিরা সেটা ভালোভাবে জানে এবং কাজে লাগায়। তারা সম্ভাব্য পাঠকদের আবেগকে কাজে লাগানোর জন্য ভুয়ো খবর তৈরি করে। তাই কোনও খবর আপনার পছন্দের হলেও তথ্য, প্রেক্ষিত, সময় যাচাই করুন ভালো করে।অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমও এই খবরটি প্রকাশ করছে কিনা দেখুন।

ভিডিও, খবর শেয়ার করার আগে…

সমাজে গোলমাল বাঁধানোর উদ্দেশে fake ভিডিও, ছবি ছড়ানো হয়। কীভাবে এবং কোন মোড়কে তা সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে ফেলবে, তা ভালো করে বোঝে ভুয়ো খবরের কারবারিরা। তাই কোনও খবর শেয়ার করার আগে একটু ভাবুন, সময় নিন, যাচাই করুন, দেখে নিন ওই বক্তব্য কোনও খবর নাকি কারও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্য থেকে বানানো।

 

Fake News রুখতে হোয়াটসঅ্যাপের পদক্ষেপ

how to spot fake news

 

এখন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এক একজন ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে ভুয়ো খবর। সেই খবরের ভিত্তি কী, উৎস কোথায় তা কিছুই বলা থাকে না। কোভিড ১৯ মহামারির সময়ও এই খবরের রমরমা। তাই হোয়াটসঅ্যাপ এবার মেসেজ ফরোয়ার্ডের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুনিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপের তরফে জানানো হয়েছে, ভুয়ো খবর যাতে অতিরিক্ত মাত্রায় ছড়িয়ে না পড়ে, সেই কারণেই মেসেজ ফরোয়ার্ডের উপর লাগাম টানা হচ্ছে। অর্থাৎ একই মেসেজ বহু হোয়াটসঅ্যাপ ইউজারকে পাঠানো যাবে না। সেই সঙ্গে বেশি সময়ের ভিডিও পাঠানোর উপরও জারি হয়েছে বিধিনিষেধ। সোশ্যাল সাইটে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়া রুখতে একাধিক রাজ্যে ধরপাকড় করছে পুলিশ। নিয়ম ভাঙলে তিন বছরের জেল পর্যন্ত হতে পারে।

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও ব্যক্তি বা গ্রুপ সঠিক কিনা যাচাই করুন

বর্তমানে কিছু কিছু ছবি আছে যা অনেক ফেক আইডিতেই প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এই ছবিগুলি দেখলেই চেনা যায়। যেমন আইডিতে শুধুমাত্র একটি ছবি, আর কিছুই নেই, এটা ফেক আইডির লক্ষণ। এছাড়া ফেক আইডিতে আসল সাইজের ছবি থাকে না, থাকে ছোট সাইজের বা কেটে নেওয়া ছবি। তাছাড়া যদি সেই আইডির বন্ধু তালিকা পাবলিক করা থাকে, তাহলে দেখে নিতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন উপায়ে গোপন করা বন্ধু তালিকাও দেখা যায়। ওই আইডি থেকে করা পোস্টের মাধ্যমেও বোঝা যায় সেটা জাল আইডি কিনা। সন্দেহের আইডিটি কী ধরনের পেজে লাইক করছে, সেখান থেকেও তার সত্যাসত্য বিচার করা যায়। সাধারণত ফেসবুকে কেউ এমন গ্রুপে জয়েন করে যা তার স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কর্মক্ষেত্র, কোনও সেবামূলক কাজ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত। ফেক আইডি এসবের তোয়াক্কা করে না। যেখানেই গ্রুপ পায়, সেখানেই জয়েন করে।

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় ইউজার নেম আর আইডি নেম এক কিনা দেখুন

how to stop fake news spread

 

ইউজার নেম একবারের বেশি বদলানো যায় না। তাই এটা হতে পারে আপনার জন্য ফেক বা রিয়েল আইডি বোঝার অন্যতম উপায়। মিলিয়ে দেখুন ইউজার নেম এবং সেই আইডিটির নাম একই কিনা।

এইসব পদ্ধতিতে সহজেই বুঝতে পারবেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেউ ভুয়ো খবর কেউ ছড়াচ্ছে কি না। তা বুঝতে পারলেই আইডি সম্পর্কে রিপোর্ট করুন। কারও ভিডিও fake বলে প্রমাণ পেলেও রিপোর্ট করুন এবং সেই ব্যক্তিকে সাবধান করুন।

Comments are closed.