সৃজিত মুখার্জির হাতে ফেলুদা ফেরত: স্মৃতিচারণায় বললেন, সৌমিত্রর ফেলুদা মগজাস্ত্র নির্ভর, সব্যসাচী অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড

এবার ফেলুদা। শহুরে, শিক্ষিত, স্মার্ট বাঙালির প্রতিবেশী ফেলুদা ফেরত আসছেন পরিচালক সৃজিত মুখার্জির হাত ধরে। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় সৃজিত জানিয়েছেন ফেলুদাকে নিয়ে তাঁর ওয়েব সিরিজ তৈরির পরিকল্পনার কথা। ছিন্নমস্তার অভিশাপ এবং যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে, ফেলুদার এই দুই গল্প নিয়ে ওয়েব সিরিজের কাজ আগামী ডিসেম্বরেই শুরু করে দেবেন তিনি। শুধু এই দুই ছবি নয়, ফেলুদা নিয়ে সৃজিত মুখার্জির মুখোমুখি thebengalstory.com

প্রশ্ন: ফেলুদা নিয়ে আপনার প্রথম স্মৃতি কী?

সৃজিত মুখার্জি: আমরা ভবানীপুরে থাকতাম, সেখানে দুটো বইয়ের দোকান ছিল। সেখান থেকে আমি ফেলুদার বই কিনতাম। সিঙ্গল মলাটে ফেলুদা। ফেলুদার কোনও নতুন বই বেরোলেই খবর পেয়ে যেতাম, বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতাম বই কিনতে। সেটাই ফেলুদা নিয়ে আমার প্রথম স্মৃতি।

প্রশ্ন: তখন আপনার বয়স…

সৃজিত মুখার্জি: আট-নয় হবে। খেলনা কেনার ব্যাপারে বাবা-মা একটু আপত্তি করতেন, কিন্তু বইয়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি কখনও। তবে এখন যতটা মনে পড়ছে, আমার প্রথম ফেলুদা পড়া এক ডজন গল্পে, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি। কিন্তু ফেলুদার সিঙ্গল বই কেনা আমার একটা অভ্যেস ছিল। সেই সময় কেনা বাদশাহি আংটি, হত্যাপুরী এখনও আমার কাছে আছে। ফেলুদা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতাম রীতিমতো।

প্রশ্ন: সেই আট-নয় বছর বা কৈশোরে ফেলুদার সেরা গল্প কোনগুলো লাগতো?

সৃজিত মুখার্জি: পরপর বললে সোনার কেল্লা, রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য, গোরস্থানে সাবধান, ছিন্নমস্তার অভিশাপ, যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে…

প্রশ্ন: আর এখন এই বয়সে পৌঁছে কি তালিকায় কোনও অদল-বদল হয়েছে?

সৃজিত মুখার্জি: হ্যাঁ, কিছুটা। এখন তালিকাটা হবে ছিন্নমস্তার অভিশাপ, যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে, দার্জিলিং জমজমাট, টিনটোরেটোর যীশু এবং গোরস্থানে সাবধান।

প্রশ্ন: সোনার কেল্লা পড়া এবং সিনেমা দেখা, এই দুটো অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনও ফারাক ছিল তখন? মানে বলতে চাইছি, সোনার কেল্লা সিনেমায় ফেলুদারা যখন যোধপুর থেকে জয়সলমীর যাচ্ছেন, তখন রাস্তায় গাড়ির টায়ার বার্স্ট করার পর ফেলুদার ইউরেকা বলে যে প্রতিক্রিয়া, ‘আমার টেলিপ্যাথির জোর আছে’, তা কি ওভাররিঅ্যাকশন লেগেছে?

সৃজিত মুখার্জি: দেখুন, আপনি যদি গল্প এবং সিনেমার মধ্যে তুলনা করেন, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার যে স্কেচ, তার সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ফেসিয়াল স্ট্রাকচার মেলে না। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ অভিনয় এবং তাঁর চোখের ব্যবহার এই অমিলকে ঢেকে দিয়েছে। তবে এটা ঠিকই, সোনার কেল্লা সিনেমায় আপনি যে দৃশ্যের কথা বলছেন, তা খানিকটা ওভাররিঅ্যাকশন বলে মনে হয়েছে। ঠিক ফেলুদাচিত নয় ব্যাপারটা। তবে ফেলুদাও রক্তমাংসের মানুষ, রোবট নন। তাই হয়তো উচ্ছ্বাস দমন করতে পারেননি।

প্রশ্ন: সোনার কেল্লার মতো জয়বাবা ফেলুনাথে কি এমন কোনও দৃশ্য আছে যা ফেলুদাচিত নয় বলে মনে হয়েছে?

সৃজিত মুখার্জি: না। জয়বাবা ফেলুনাথে শুধু একটা জিনিস চোখে লেগেছে, তা হল ফেলুদার উইগ। আমার মতে এই দুটো ছবির মধ্যে সোনার কেল্লা এগিয়ে।

প্রশ্ন: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পর ফেলুদা বলতে বাঙালির মনে গেঁথে গিয়েছে সব্যসাচী চক্রবর্তী। এই দুই ফেলুদা নিয়ে আপনার কী মত?

সৃজিত মুখার্জি: এক কথায় বললে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনেক সেরেব্রাল, সব্যসাচী চক্রবর্তী অনেক ফিজিক্যাল। আপনি বলতে পারেন সৌমিত্রর ফেলুদা মগজাস্ত্র নির্ভর, সব্যসাচীর ফেলুদা অনেক অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড। তবে আপনি যদি বইয়ের স্কেচ দেখেন, ফেলুদার সঙ্গে সব্যসাচী চক্রবর্তীর মুখের মিল বেশি।

প্রশ্ন: এবার আপনার ফেলুদা ফেরত প্রসঙ্গে আসি, ছিন্নমস্তার অভিশাপ এবং যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে বাছার কারণ কী? এ কি ব্যক্তিগত পছন্দ, নাকি এই দুটো গল্পের কোনও উপাদান সিনেমায় বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পারে?

সৃজিত মুখার্জি: দুটোই। এই দুটো গল্পই আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং অত্যন্ত ঘটনাবহুল। অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড। সবচেয়ে বড় কথা সুপার ভিলেন মগনলাল মেঘরাজের উপস্থিতি। এবং ফেলুদার গল্প শুধু রহস্য গল্পই নয়, একটা ভ্রমণ কাহিনী হিসেবেও তাকে দেখতে পারি আমরা। সেখানে এই দুটো গল্পেই টানটান ব্যাপার আছে, তেমনই লোকেশনও একটা ফ্যাক্টর।

প্রশ্ন: আপনার ফেলুদা ফেরতে কে কোন চরিত্রে অভিনয় করছেন তা নিয়ে একটা কৌতুহল, আলোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে…

সৃজিত মুখার্জি: ফেলুদা টোটা রায়চৌধুরী, তা সবাই জেনেই গিয়েছেন। তোপসে হচ্ছে কল্পন মিত্র। লালমোহন গাঙ্গুলিও চূড়ান্ত। মগনলাল মেঘরাজ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিন্নমস্তার অভিশাপের কারান্ডিকর, সেটাও এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সবাই জানতে পারবেন এই চরিত্রগুলোর অভিনেতা কারা।

প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়ের পর অনেক পরিচালক ফেলুদাকে নিয়ে সিনেমা করেছেন। এবার সৃজিত মুখার্জির হাতে ফেলুদা। এত বছর বাদে কি ফেলুদার প্রতি একটা জাস্টিস হল, একজন ফেলুদাপ্রেমী কী বলেন?

সৃজিত মুখার্জি: এ নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। আমার ছোটবেলার একটা স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে, এটুকুই বলতে পারি। শুধু ফেলুদা করব বলে একাধিক হিন্দি, বাংলা কাজের প্রস্তাব ছেড়েছি। ফেলুদার প্রতি জাস্টিস করতে পারলাম কিনা তা দর্শক বলতে পারবেন। তবে এই দুটো ফেলুদা করার পর আরও দুটো করার ইচ্ছে আছে, দেখা যাক।

প্রশ্ন: আমার শেষ প্রশ্ন, যে দুটো গল্প নিয়ে আপনি ছবি করছেন, তাতে কি আজকের প্রজন্মের কথা ভেবে বা আজকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কথা ভেবে কোনও বদলের পরিকল্পনা আছে?

সৃজিত মুখার্জি: না, বদল তেমন নেই। তবে ছিন্নমস্তার অভিশাপ আমি করব সাতের দশকের পটভূমিকায়। সেই সময়টাকে ধরব ছবিতে। কিন্তু যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে করছি আজকের দিনের পটভূমিকায়। এর একটা বড় কারণ, ভূমিকম্পের পর কাঠমান্ডুর ল্যান্ডস্কেপে একটা বদল হয়েছে। গল্পের সময়কার দরবার স্ক্যোয়ার আজ আর নেই। আজকের পটভূমিকায় করার জন্য গল্পে কিছু বদল করতে হচ্ছে।

 

Comments are closed.