মাসে লক্ষাধিক টাকার চাকরি ছেড়ে ‘রাস্তার ধারে’ মোমো বিক্রি শুরু করেছেন সৌভিক, ‘হৃদয়ে মোমো’র নেপথ্যের গল্প বললেন TheBengalStory-কে  

শান্তিনিকেতনে ঘুরতে গিয়ে শীতের সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে যদি পৌঁছে যান  ডাকঘরের কাছে, উল্টো দিকে দেখবেন একটি টোটো দাঁড়িয়ে। আর পাঁচটা সাধারণ টোটোর থেকে একটু আলাদা দেখতে টোটোর মাথায় জ্বলজ্বল করছে লাল রঙের একটি সাইন বোর্ড। যাতে লেখা রয়েছে ‘হৃদয়ে মোমো’। টোটো ঘিরে মোমো প্রেমীদের ভিড়। 

এই ধরণের উদ্যোগের ক্ষেত্রে সাধারণত রান্না-প্রেম কাজ করে। যদিও এক্ষত্রে গল্পটি সম্পূর্ণ আলাদা। ছোটবেলা থেকে একদমই রান্নাবান্না পছন্দ করতেন না, এক গ্লাস জলও নিজে নিয়ে খেতেন না। সেই সৌভিক গোড়াই লক্ষাধিক টাকার চাকরি ছেড়ে রাস্তার ধারে মোমর দোকান দিয়েছেন। রাঁধুনি নিজেই। নামি সেফ-এর কাছে একবছরের জন্য রান্নাও শিখেছেন। মুম্বইয়ের এরকম চাকরি ছেড়ে রাস্তার ধারে কেন মোমোর দোকান দিলেন? সেই গল্প বললেন TheBengalStory-কে। 

হঠাৎ মোমোর দোকান দিলেন কেন? এক কথায় বলতে গেলে, শান্তিনিকেতনের প্রতি ভালোবাসা এবং এক বন্ধুর একটি কথা, জানালেন সৌভিক। কীরকম? দেখুন জন্ম শান্তিনিকেতনে। এখানে মাঠঘাটেই বড় হয়েছে। পড়াশোনাও বিশ্বভারতীতে। মুম্বই যখন চাকরি পেলাম, ওই বদ্ধ জীবন মেনে নিতে পারলাম না। প্রাইভেট সেক্টর হলেও কাজের চাপ ছিল না।  কিন্তু ছয় মাস চার দেওয়ালের মধ্যে কাটিয়ে কেমন দমবন্ধ লাগলো। মনে হচ্ছিলো আমি ভিতরে ভিতরে ফুরিয়ে যাচ্ছি। তখন থেকেই ভাবনা শুরু করলাম। আর বন্ধুর বিষয়টা? হ্যাঁ ওই বন্ধুর কথা না বললে, ‘হৃদয়ে মোমো’র নেপথ্যের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যখন প্রাথমিক ভাবে ব্যবসার পরিকল্পনা করি।  ওই বন্ধুও আমার সঙ্গে ছিল। কিন্তু মাঝ পথেই ও সরে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, ও আমায় বলেছিল, ওকে ছাড়া আমি এই ব্যবসা কোনোমতেই শুরু করতে পারবো না। ওই কথাতেই মাথায় কেমন জেদ চেপে গেল। আর হৃদয়ে মোমো নামটা কীভাবে ভাবলেন? জায়গাটার নাম তো শান্তিনিকেতন, হেঁসে উত্তর দিলেন সৌভিক।  

রান্না করতে তো পছন্দ করতেন না বললেন। তাহলে… প্রশ্ন শেষের আগেই সৌভিকের উত্তর, এর পেছনেও ওই জেদই কাজ করেছে। শান্তিনিকতনে অনেক লোক খুঁজলাম। তেমন পেলাম না। অনেকে ব্যবসায় নতুন জেনে কাজও করতে চাইলো না। তাই নিজেই জেদ করে কলকাতায় গিয়ে এক সেফ-এর কাছে এক বছরের একটা কোর্স করলাম।  

সৌভিকের বাবার শান্তিনিকেতনেই একটি ছোট ফার্নিচারের দোকান রয়েছে। এক দাদা কম্পিউটার মেকানিক। মধ্যবিত্ত পরিবারে মেধাবী সৌভিককে  নিয়ে মা বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। সৌভিকের চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত কার্যত বাজ পড়েছিল পড়েছিল পরিবারে। সৌভিক জানালেন, এখনও তাঁর মোমো বিক্রির সিদ্ধান্ত মা, বাবা মেনে নিতে পারেননি। সেই সঙ্গে তাঁর আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য,চেষ্টা করছি হৃদয়ে মোমোকে একদিন এমন জায়গার নিয়ে যাওয়ার, যাতে মা বাবা আমায় নিয়ে আবারও গর্ব করেন। হৃদয়ে মোমোকে একটি ব্র্যান্ড-এ পরিণত করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। 

শুধু মা বাবা নয়।  সৌভিক জানালেন, দোকান শুরু করার পর অনেক বন্ধু তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেছেন। তবুও প্রধা ভাঙার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন জাপানিজ ভাষায় মাস্টার্স করা সৌভিক। গ্রাজুয়েশনের পর জাপানে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল, কিন্তু পার্সপোর্ট না থাকায় যেতে পারেননি। বললেন, জাপান যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওই আর কী…।  

সৌভিকের সঙ্গে একই কোম্পানিতে ২০১৭ সালে যারা কাজে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের বর্তমান বেতন মাসে এক লক্ষের একটু বেশি।  চাকরি ছাড়ার জন্য আফসোস হয় না ? এটা সত্যি যে আমি এখন অত টাকা রোজগার করিনা। কিন্তু স্বপ্নটারও যে গুরুত্ব রয়েছে। তা ছাড়া এখন আমার এই দোকানে আরও ৬ জন কর্মচারী রয়েছে, আমায় সাহায্য করার জন্য। আমিও অল্প হলেও তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। এটাও তো কম পাওয়া নয়। 

সৌভিক ভালোবাসেন ছবি তুলতে, কবিতা লিখতে, আঁকতে।  তাঁর ইচ্ছে রয়েছে, নিজের তোলা ছবি ও কবিতার একটি সংকলন দোকানে রাখবেন। মোমোর জন্য অপেক্ষার সময় বই পড়ার সুযোগ পাবেন ক্রেতারা। অনেকে প্রথা ভেঙে নিজের নিয়মে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে ‘হৃদয়ে মোমো’-র কর্তার বার্তা, স্বপনের জন্য সবকিছুকে ছাড়ো, শুধু হাল ছেড়ো না।         

Comments are closed.