গুগলের চাকরি ছেড়ে সিঙ্গাড়া বিক্রি, মুম্বইয়ের মুনাফ কপাডিয়ার ‘দ্য বোহরি কিচেন’ এর ফ্যান বলিউডের তারকারাও
কথায় বলে, কারোর মন জয় করতে হলে খাবার হল মোক্ষম অস্ত্র। এটা ভালোই বুঝেছিলেন মুম্বইয়ের মুনাফ কপাডিয়া। তাই মায়ের হাতের বিভিন্ন পদ দিয়েই আস্ত রেস্তরাঁ খুলে তাক লাগিয়েছেন খাদ্যরসিক এই মুম্বই নিবাসী। ফোবর্স ইন্ডিয়া পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদনে জায়গা করে নেওয়া, গুগলের কর্মী থেকে স্বাধীন ব্যবসায়ী মুনাফের উত্তরণের কাহিনি কিন্তু চমকপ্রদ।
সিয়া ইসলামের একটি শাখা হল দাউদি বোহরা সম্প্রদায়। মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেনে আদি বাসস্থান। সেই দাউদি বোহরা সম্প্রদায় থেকে আসা মুম্বইবাসী মুনাফ দেখেছেন, তাঁদের বাড়িতে যে সব পদ রান্না হয় বা তাঁরা যে সব খাবার খান, মুম্বইয়ে তার খুব একটা চল নেই। স্মোকড কিমা সামোসা, কাজু চিকেন, নল্লি নিহারির মতো পদগুলি হয়ত বড় রেস্তরাঁয় পাওয়া যায়, কিন্তু সাধারণের মধ্যে তার চল খুব কম। এসব ভাবনা থেকেই গুগলের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে মুনাফ তৈরি করে ফেলেন ‘দ্য বোহরি কিচেন’ (TBK)। বলিউডের রানি মুখার্জি থেকে হৃত্বিক রোশন, বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এখন মুনাফের খাবারের প্রেমে মশগুল।
গুগলের মতো বিখ্যাত সংস্থার চাকরি ছেড়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে গিয়ে বারবার ধাক্কা খেয়েছেন। কিন্তু এই কাজের প্রতি মুনাফের ভালোবাসা আর বিশ্বাসের জন্যই আজ মুম্বইয়ের এক পরিচিত নাম তিনি। যাঁকে নিয়ে ‘The Guy Who Quit Google to Sell Samosas’ শীর্ষকে বই লেখা হয়। বিবিসি-র মতো সংবাদমাধ্যম যাঁকে নিয়ে খবর সম্প্রচার করে। ফোবর্স পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় যিনি জায়গা করে নেন।
খাবারের ব্যবসা করবেন এমনটা ছোট থেকে ভাবেননি। তবে গড়পড়তা চাকরি যে তিনি করবেন না তা স্থির করে নিয়েছিলেন মুনাফ কপাডিয়া। মুম্বইয়ের নারসি মঞ্জি কলেজ অফ কমার্স অ্যান্ড ইকনমিক্স থেকে মার্কেটিংয়ে বিবিএ করেন।২০১১ সালে এমবিএ পাশ করে একটি সংস্থার ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করেন। পাশাপাশি গুগলের অ্যকাউন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট পদে কাজের জন্য আবেদন করেছিলেন মুনাফ। চাকরি পেয়েও যান। কাজের জন্য মুম্বই থেকে হায়দরাবাদ যেতে হয় মুনাফকে। তবে নয় মাসের মধ্যে প্রমোশন পেয়ে ফের মুম্বইয়ে ফেরেন তিনি। ঠিক সেই সময় গুগলে কাজ করতে করতেই দ্য বোহরি কিচেন গড়ার প্রস্তুতি নেন মুনাফ। ইচ্ছে ছিল, নিজের ব্যবসার নেশা আর চাকরি দুটোকেই ব্যালান্স করে চলবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। পাঁচ বছর গুগলে কাজ করার পর অবশেষে ২০১৫ সালে তা ছেড়ে তৈরি করে ফেলেন দ্য বোহরি কিচেন।
মুনাফ জানান, দ্য বোহরি কিচেনের শুরুটা একটু অন্যরকম। সেটা ২০১৪ সাল, তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতদের নিমন্ত্রণ করে মা নাফিসা বিভিন্ন পদ রান্না করে খাওয়ান। সেই খাবার খাওয়ার পর তাঁদের প্রশংসাই দ্য বোহরি কিচেনের পথ তৈরি করেছিল। এই দুর্দান্ত অভিজ্ঞতার পরে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পরে, মা-ছেলে মিলে প্রতি সপ্তাহে একসঙ্গে আট জনের জন্য বাড়িতে খাবারের আয়োজন করতে থাকেন। এরকম জিনিস আগে হয়নি। আস্তে আস্তে নাম ছড়ায় দ্য বোহরি কিচেনের।
দ্য বোহরি কিচেনের অন্যতম গুণমুগ্ধ ছিলেন ঋষি কাপুর। এছাড়া রানি মুখার্জি, হৃত্বিক রোশন সহ বিভিন্ন বলিউড অভিনেতার যাতায়াত মুনাফের দ্য বোহরি কিচেনে।
বর্তমানে টিবিকের দুটি ডেলিভারি কিচেন। গত মার্চ মাস পর্যন্ত মাসে তিনবার করে এক্সক্লুসিভ ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্সের আয়োজন করা হত। যেখানে জনপ্রতি খরচ ১,৫০০ থেকে ৩,৫০০ টাকা। এখানকার ৪০ শতাংশ ডিশ নিরামিষাশীদের জন্য। রাঁধুনিদের ট্রেনিং দেন মুনাফের মা নিজে। কেটারিং-এর সুবিধাও রয়েছে। জন্মদিন, বিয়ের পার্টির খাবারের জন্য মুম্বই ছাড়িয়ে এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার আসে। প্রশিক্ষিত শেফ ও স্টাফদের এই অনুষ্ঠানে পাঠানো হয় বিশেষ থালি দিয়ে। ৩০ টি থালিতে ৩০০ জনকে খাবার খাওয়ানো যায়, জানান মুনাফ।
কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যের চাকরি ছেড়ে স্বাধীন ব্যবসা করা তো মুখের কথা নয়। মুনাফের পক্ষেও বড্ড কঠিন ছিল এই সফর। বেশ কয়েকবার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। যেমন ২০১৫ সালে এনএইচ৭ উইকএন্ডার মিউজিক ফেস্টিভ্যালে খাবারের স্টল দিয়ে ৫০ হাজার টাকা লোকসান হয়। ২০১৬ সালে অ্যাপের মাধ্যমে খাবার ডেলিভারি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখানে ক্রেতারা এমন কম রেটিং দিলেন যে ব্যবসা উঠে যাওয়ার জোগাড়। মুনাফ ভাবতে থাকেন হয়ত তাঁর মায়ের হাতের খাবার সবার মুখে ভালো লাগছে না।
২০১৬ সালে প্রায় দেউলিয়া হয়ে অন্য কাজ করার কথা ভাবতে থাকেন মুনাফ। ঠিক সেই সময় বিখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস ইন্ডিয়া যোগাযোগ করে তাঁর সঙ্গে। তাদের ‘৩০-আন্ডার-৩০’ ইস্যুতে জায়গা দেওয়া হয় মুনাফ ও তাঁর টিবিকে-কে। আবার নিজের উপর ভরসা ফিরে পান মুনাফ কপাডিয়া। এই ইস্যুর পর ব্যবসায় একাধিক পরিবর্তন আনেন তিনি। মায়ের রান্নার পদ্ধতি নিজে ভালো করে শেখেন। আস্তে আস্তে বহর বাড়তে থাকে ব্যবসার। উৎসাহী বিনিয়োগকারী পেতে শুরু করেন তাঁরা। এখন পাঁচটা আউটলেট দ্য বোহরি কিচেনের। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ব্যবসার বহর কিছুটা কমিয়েছেন মুনাফ। ৫০ শতাংশ কর্মীকে ছাড়িয়ে দিতে হয়েছে। যদিও মুনাফের আশা খুব শীঘ্রই অবস্থার বদল আসবে। আবার হইহই করে চলবে ব্যবসা, খাদ্যরসিকদের মুখে দেখবেন প্রসন্নতা। সেই অনুযায়ী ব্যবসায় বদল আনছেন গুগলের প্রাক্তন কর্মী, সামোসা বিক্রেতা মুনাফ কপোডিয়া।
Comments are closed.