পা ভেঙে পড়ে আছেন বাবা আর দৃষ্টিশক্তিহীন মা। তাঁদের তিন চাকার ভ্যানে চাপিয়ে নিজে প্যাডেল ঘুরিয়ে বারাণসী থেকে ৬০০ কিলোমিটার পেরিয়ে বিহারের আরারিয়ার গ্রামে পৌঁছে গেল ১১ বছরের তাবারাক!
কিছুদিন আগে লকডাউনে বন্দি এক পরিযায়ী শ্রমিক কন্যার অমানুষিক পরিশ্রমের ছবি দেখেছে দেশ। বিহারের সেই ১৫ বছরের জ্যোতি কুমারী অসুস্থ বাবাকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে গুরুগ্রাম থেকে ১২০০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছেছিল বিহারের গ্রামে। কয়েকদিন পর সেই একই রকম দৃশ্যের সাক্ষী হল লকডাউনের ভারত। সেই বিহারেরই ১১ বছরের পুচকে তাবারাক টানা ৯ দিন ভ্যান চালিয়ে ৬০০ কিমি রাস্তা পেরিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল অসুস্থ বাবা-মাকে। তাবারাকের যাত্রা শুরু হয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসী থেকে।
বিহারের আরারিয়া জেলার একটি গ্রামে একচিলতে জমিতে ছোট্ট কুঁড়েঘর তারাবাকদের। নিজেদের জমি-জায়গা বলতে কিছুই নেই। সেখানে ফিরতেই উত্তরপ্রদেশ থেকে বাবা-মাকে ভ্যানে চাপিয়ে ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিল হাসিখুশি তাবারাক।
ধান কাটতে গিয়ে চোখে আঘাত লেগে অন্ধ হয়েছেন মা। বড়ভাই কাজের জন্য ছিলেন তামিলনাড়ুতে। লকডাউনে সেখানেই আটকে পড়েছেন। তিন দিদির মধ্যে এক দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাবা ইস্রাফিল প্রায় কুড়ি বছর ধরে বারাণসীর মার্বেলের দোকানে কাজ করেন। বাড়িতে দুই দিদি আর মা থাকতেন, আর বাবার কাছে থাকত ছোট্ট তারাবাক। গত ফেব্রুয়ারি থেকে বাবা একাই ছিলেন বারাণসীতে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে বাবার পা ভাঙার খবর পেয়ে মাকে নিয়ে তড়িঘড়ি বারাণসী পৌঁছয় সে।
এদিকে করোনা সংক্রমণ রুখতে গত মার্চ মাসে আচমকা লকডাউনের ডাক দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বহু পরিযায়ী শ্রমিকের মতো এই পরিবারটিও কর্মহীনভাবে বন্দি হল বাড়ি থেকে কয়েক’শো কিলোমিটার দূরে, নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসীতে। কিন্তু লকডাউন যে শেষ হওয়ার নাম নেই! মাসের পর মাস এইভাবে থাকলে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরতে হবে। তাই বাড়ি ফেরাটা জরুরি বলে মনে করলেন পা ভেঙে বসে থাকা ৫৫ বছর বয়সী ইস্রাফিল। তবে অনেক ভেবেও ফিরবেন কীভাবে, তার কূলকিনারা পাননি অসহায় দম্পতি। শেষে ছেলের বুদ্ধিতে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করেন তাঁরা। কী সেই ব্যবস্থা? কাজের সুবিধার জন্য একটা তিন চাকার ভ্যান কিনেছিলেন ইস্রাফিল। তাতেই মা-বাবাকে চাপিয়ে ৬০০ কিলোমিটার রাস্তা পার করে নিয়ে গেল ১১ বছরের ছেলে!
কীভাবে পারলে এই কাজ? ভয় করেনি? সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে তারাবাকের সহজ উত্তর, আমাদের মতো অনেকেই তো এভাবেই বাড়ি ফিরছেন। তাই আমিও সেই পথ ধরলাম। এত ভারী ভ্যান চালাতে গিয়ে ক্লান্ত লাগে না? আবার মুচকি হাসি দিয়ে বাড়ির পথ ধরে সে।
তারাবাকের মা জানান, বাচ্চা ছেলেটির উপর এই অমানুষিক ভার তুলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না তাঁদের কাছে। স্বামীর শরীর অসুস্থ, বাড়িতে দুই মেয়ে আছে। আর কীভাবেই বা ফিরতাম আমরা? প্রশ্ন তাঁর। বলেন, এখন মরতে হলে গ্রামেই একসঙ্গে মরবো।
তারাবাকরা এখন স্থানীয় কোয়ারেন্টিন সেন্টারে রয়েছে। স্থানীয় আরজেডি বিধায়ক শাহনাজ আলম পরিবারটিকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ১১ বছরের তাবারাকের এই হাসিমুখে প্যাডেল ঘোরানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। বিরোধীরা ট্যুইটারে সেই ভিডিও পোস্ট করে কটাক্ষ করছেন, হয়ত এমন ‘আত্মনির্ভর’ ভারত গড়ার কথাই বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
Comments are closed.