নব্বইয়ের দশক। টিভি মানেই তখন জমায়েত। ছুটির দুপুরের ম্যাটিনি শো হোক বা সন্ধ্যের কোনও অনুষ্ঠান। সারা পাড়ায় হয়তো একটাই টিভি। সেই টিভি দেখাকে ঘিরে ধরেই একটা ছোট্ট ভিড়। ছোট থেকে বড় সবাই ডুবে বাংলা ছবিতে। আজকের সময় যা কল্পনা করাটাও মুশকিল। ঠিক ওই সময়ে দর্শকদের মনে যে ছবিগুলো রাজত্ব করেছে, তাতে তরুণ মজুমদারের ছবি থাকবেই। খণ্ড খণ্ড সাধারণ যাপনকে কোলাজ করেই সেলুলয়েডে মায়া তৈরি করতেন তরুণ মজুমদার। তাঁর ছবির চরিত্রগুলো খুব চেনা, ঘটনাগুলোও পরিচিত, অথচ তাঁর মধ্যে থেকেই পর্দায় এমন কিছু একটা করতেন যা সমাজের সব স্তরের দর্শকদেরই ছুঁয়ে যেত। ‘ভালোবাসাই’ যেন তরুণ মজুমদারের ছবির মূল নির্যাস।
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল জামানেতে যাত্রা শুরু করলেও সিনেমাপাড়ায় নিজের এক আলাদা জায়গা করেছিলেন বর্ষীয়ান এই পরিচালক। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন যৌথ পরিবারগুলো একে একে ভাঙতে শুরু করেছে, সেই সময় নিজের ছবিতে যৌথ পরিবারের গল্প বলতে শুরু করেছিলেন তরুণ মজুমদার। ১৯৫৯ সালে ‘চাওয়া পাওয়া’ তাঁর প্রথম ছবি। এই পর একে একে ‘পলাতক’ (১৯৬৩), ‘বালিকা বধূ (১৯৬৭), ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ (১৯৭৩), ‘গণদেবতা’ (১৯৭৮), ‘দাদার কীর্তি’ (১৯৭৯), ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’-এর মতো একের পর এক যুগন্তকারী ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। সমালোচকদের পাশপাশি অক্স অফিসেও তখন তিনি ‘হিট’। চিত্রনাট্য পাল্টেছে, চরিত্র পাল্টেছে, পেক্ষাপট পাল্টালেও প্রতিটি ছবিতেই তিনি ভালোবাসার কথাই বলতে চেয়েছেন। আর এখানেই তিনি আজও ‘চিরতরুণ’।
তরুণ মজুমদারের ছবির আর এক বিশেষত্ব ছিল বাংলার গ্রাম। খুব কম পরিচালকই তাঁর মতো পর্দায় গ্রামকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর ছবি মানেই গ্রাম বাংলার পুকুর, মেঠো পথ, নারকেল গাছের সারি,বাঁশ বন। সাহিত্য নির্ভর ছবিও করেছেন তিনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উপন্যাস নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। ২০১৮ সালে তাঁর শেষ মুক্তি প্রাপ্ত ছবি ‘ভালোবাসার বাড়ি’। ২০১৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস নিয়ে ধারাবাহিক তৈরির কাজেও হাত দিয়েছিলেন তিনি। অবশেষে ৯১ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন বাংলা ছবির ‘তরুণ’ পরিচালক।
Comments are closed.