বিজেপিকে পরাস্ত করাই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব। বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করতে সিপিআই (এম) কাজ করবেঃ মানিক সরকার।
ত্রিপুরার টানা সিপিএম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মানিক সরকার। বর্তমানে ত্রিপুরার বিরোধী দলনেতা এবং সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকারের মুখোমুখি thebengalstory.com
প্রশ্নঃ দীর্ঘদিন সরকার চালিয়ে আজ আপনারা বিরোধী দলে। এত বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর বিরোধী দলনেতা হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন। টানা এতদিন প্রশাসন চালানো কি বিরোধী দলনেতার কাজে কোনও সমস্যা সৃষ্টি করছে?
মানিক সরকারঃ সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে কোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই ব্যবস্থায় এগুনো আছে, পিছানো আছে। কখনও সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়, কখনও বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হয়। যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গিসহ মানসিক প্রস্তুতি থাকলে দায়িত্ব দু’রকম হলেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
শাসক বা বিরোধী দল যে অবস্থানেই থাকি না কেন, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসাবে আমাদের কাজ হচ্ছে জনগণের, বিশেষ করে শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিতসহ দুর্বল, পিছিয়ে পড়া জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে কাজ করা, কথা বলা, কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া।
রাজ্যের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকার সময় এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আমরা কাজ করার চেষ্টা করেছি। রাজ্যে আমাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে সে দিনগুলোতে যাঁরা বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছিলেন তাঁদের কাছে আমরা গঠনমূলক ভূমিকা প্রত্যাশা করতাম। কিন্তু অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। আমরা বরাবরই বিরোধী দলের কাছ থেকে অন্ধ বিরোধিতার ভূমিকা প্রত্যক্ষ করতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
সুদীর্ঘ রাজ্য সরকার পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে এখন আমাদের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। প্রথম থেকেই আমরা গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। প্রথম থেকেই আমরা গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে চলেছি বিধানসভার ভেতরে এবং বাইরে। বিরোধী দল বলে সব কিছুতেই যুক্তহীনভাবে অন্ধ বিরোধিতা করা যে আমাদের পথ নয় তা আমরা স্পষ্টভাবেই জনসমক্ষে তুলে ধরছি। সরকার পরিচালনার সুযোগকে সর্বতোভাবে জনস্বার্থে, রাজ্যের স্বার্থে কাজে লাগানোর আন্তরিক চেষ্টা করেছি। বিরোধী দলের ভিন্ন অবস্থান থেকেও একই ভূমিকা নেবার চেষ্টা করছি অন্যভাবে।
অবস্থানগত দিক থেকেই শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যে মৌলিক ফারাক বা পার্থক্য রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে সরকার পরিচালনায় থেকে বিরোধী দলের দায়িত্ব প্রতিপালনে প্রাথমিক কিছু অসুবিধা হওয়াটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তা সাময়িক।
প্রশ্নঃ আগে আপনারা ত্রিপুরায় মূলত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তৃণমূলের বিরুদ্ধেও লড়েছেন, কিছুটা হলেও। কিন্তু বিজেপি একটা নতুন প্রতিপক্ষ। কংগ্রেস-তৃণমূলের থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনও মৌলিক ফারাক আছে ? মানে প্রশাসক এবং বিরোধী নেতা হিসবে আপনার অভিজ্ঞতায় এই তিন দলের মধ্যে তফাৎ কী?
মানিক সরকারঃ কংগ্রেসকে দিল্লির এবং রাজ্যের সরকারে দেখেছি। রাজ্যে বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখেছি। তৃণমূলকে পশ্চিম বাংলায় বিরোধী দলের এবং বর্তমানে শাসক দলের ভূমিকায় দেখছি। বিজেপিকে দিল্লির সরকারে দেখেছি ও দেখছি। ত্রিপুরায় বিরোধী দল ও বর্তমানে শাসক দলের ভূমিকায় দেখছি।
শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে কংগ্রেস ও বিজেপি দলের মধ্যে মৌলিক ফারাক নেই। ফারাক ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী ও অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে। তৃণমূল বাহ্যিকভাবে যে কোনও মুখোশই ধারণ করুক না কেন মৌলিকভাবে অর্থনৈতিক প্রশ্নে কংগ্রেস এবং বিজেপির সঙ্গে এই দলের তেমন কোনও ফারাক নেই মাঝে মাঝে এখানে সেখানে কিছু কৌশলি ভিন্নতর ভূমিকা গ্রহণ করা ছাড়া।
বিজেপি এখন কেন্দ্রীয় সরকারে রয়েছে। অর্থনীতি থেকে শুরু করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে জনবিরোধী প্রবল আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে চলেছে। সাধারণভাবে দেশের আমজনতার সাথে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বন্দ্ব বিরোধ তীব্র, তীক্ষ্ণ ও বিস্তৃত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সামনের উচ্চতর পর্যায়ের জাতীয় রাজনৈতিক সংগ্রামে বিজেপিকে পরাস্ত করাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব।
প্রশ্নঃ তিন মাসের কিছু বেশি হয়েছে ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার। সিপিআই (এম) এর পার্টি অফিস ভাঙা দিয়ে শুরু। তারপর থেকেই ত্রিপুরা গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের নজরে। কখনও আইন-শৃঙখলার অবনতি। কখনও মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট ছিল’, তো কখনও কিডনি পাচার নিয়ে গণপিটুনি। বিরোধী দলনেতা হিসেবে মানুষের কী প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন নতুন সরকার নিয়ে?
মানিক সরকারঃ সাধারণভাবে সকালবেলার আকাশ দেখে মানুষ বুঝতে পারেন সারা দিনটি কেমন যাবে। ঠিক তেমনই বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের প্রথম কয়েক মাসের কাজ দিয়ে এই সরকার কোন পথে চলেছে-রাজ্যের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে মানুষ অনুমান করতে শুরু করেছেন। যদিও স্বল্প সময় অতবাহিত হয়েছে কিন্ত এর মধ্যেই মানুষ দেখছেন-বিরোধী দলের বিরুদ্ধে রাজ্যব্যাপী অভাবনীয় স্বৈর সন্ত্রাস, গণতন্ত্রের উপর বেপরোয়া আক্রমণ, প্রচার মাধ্যমের বিরুদ্ধে আক্রমণ, কাজ নেই, খাদ্যের সমস্যা, নিম্ন আয়ী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিক-শ্রমজীবীদের বেআইনি ও অমানবিকভাবে ছাঁটাই, ব্যবসায়-বাণিজ্যে এই সব কিছুর নেতিবাচক প্রভাব, ছেলেধরা ও কিডনি পাচার চক্রের নামে গণপিটুনি-হত্যা-জখম, সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উত্তরোত্তর জটিলতা বৃ্দ্ধি, মহিলাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বৃ্দ্ধির ঘটনাবলীর ভিত্তিতেই হাটে, ঘাটে, মাঠে সাধারণ মানুষের একাংশ অত্যন্ত সরলভাবেই সরকার সম্পর্কে নিজেদের মোহ ও আশা ভঙ্গ এবং হতাশার মনোভাব ব্যক্ত করতে শুরু করেছেন।
প্রশ্নঃ সারা দেশে আজকে যে পরিস্থিতি তাতে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই কোন পথে হবে, কীভাবে হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল বিভিন্ন কথা বলছে? আপনারাও বিজেপিকে মূল বিপদ বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আপনি কি মনে করেন, কংগ্রেসের নেতৃত্বে এই লড়াই করে তা জেতা সম্ভব? কংগ্রেসের কি আদৌ সেই বিশ্বাসযোগ্যতা আছে?
মানিক সরকারঃ দু’নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলেছি। তারপরেও বলবো ভারতবর্ষ বৈচিত্রে ভরা একটি বিরাট দেশ। একেক রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেক রকম। মূল লক্ষ্য হিসেবে বিজেপিকে পরাস্ত করার বিষয়টিকে স্থির করে নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে প্রকৃ্ত বিজেপি বিরোধী ভোট সমবেত করতে উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টিকেই প্রধান্য দিতে হবে। এর উপর ভিত্তি করেই একেক রাজ্যে একেক রকম কৌশল ঠিক করতে হবে। ভোটের পরেই ঠিক হবে বা বোঝা যাবে জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী ঐক্যমঞ্চের চেহারা কীরকম হবে এবং কোন দলের ভূমিকা কী হবে বা কোন দল কী ভূমিকা নিচ্ছে।
প্রশ্নঃ আপনারা ত্রিপুরায় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছেন, পশ্চিমবঙ্গ পার্টি মূলত লড়াই করছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। দু’ জায়গাতেই আপনারা বিরোধী। আবার কেরলে সিপিআই (এম) সরকার লড়ছে কংগ্রেসের সঙ্গে। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে কি একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব গোটা দেশে? এ ক্ষেত্রে সিপিআই (এম) এর ভূমিকা কী হবে?
মানিক সরকারঃ বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করতে সিপিআই (এম) কাজ করবে। কিন্তু নিজেদের শক্তি ও সামর্থ সম্পর্কে সিপিআই (এম) সচেতন। সিপিআই (এম) জানে জাতীয় রাজনীতিকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করার অবস্থায় সে নেই। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে প্রভাবিত করার প্রশ্নে জাতীয় রাজনীতিতে সিপিআই (এম) এর গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতাকে অস্বীকার করা যাবে না। এ বিষয়ে সচেতন থেকেই যথাসময়ে যথার্থ অবস্থান গ্রহণে সিপিআই (এম) পিছিয়ে থাকবে না, বরং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের প্রশ্নে সদর্থক প্রয়াসেও খামতি থাকবে না বলে আমার বিশ্বাস।
প্রশ্নঃ পশ্চিমবঙ্গ পার্টির মধ্যে এখনও একটা ঝোঁক আছে, লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে একটা সমঝোতা করার। কিন্তু এখন কিছু রাজ্যভিত্তিক দলের যা শক্তি, বিশেষ করে তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, বিএসপি (আপনাদের মতে যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে) তাদের বাদ দিয়ে কি বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই সম্ভব?
মানিক সরকারঃ পশ্চিম বাংলায় সিপিআই (এম) এর বর্তমান স্লোগান হচ্ছে, ‘বিজেপি হঠাও দেশ বাঁচাও, তৃণমূল কংগ্রেস হঠাও পশ্চিম বাংলা বাঁচাও’।
সদ্য অনুষ্ঠিত আমাদের ২২ তম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে যে রাজনৈতিক লাইন স্থির হয়েছে তাকে ভিত্তি করেই উপরোক্ত স্লোগান বাস্তবায়নে আমাদের পশ্চিম বাংলার পার্টি যথার্থ ভূমিকা নেবে। এটাই স্বাভাবিক।