২০২১ সালেই তাঁর রাজনৈতিক সফরের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। জীবনে প্রথম নির্বাচন লড়েছিলেন বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে। শেষ নির্বাচনও লড়লেন বালিগঞ্জ থেকে। ৫০ বছরের এক বর্ণময় বৃত্ত সম্পূর্ণ করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আপামর অভিজাত্যে মোড়া বর্ষীয়ান রাজনীতিক সুব্রত মুখার্জি। কালীপুজোর রাতে এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী।
১৯৪৬ সালের ১৪ জুন বজবজের সারেঙ্গাবাদে জন্ম গ্রহণ করেন সুব্রত মুখার্জি। মফস্বলের ছেলে হলেও খুব সহজেই কলকাতায় খাপখাইয়ে নেন নিজেকে। বলা ভালো, সত্তরের দশক থেকে শহরটাকে শাসন করতে শুরু করেন তিলোত্তমার প্রাক্তন মহানগরীকে।
স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে পড়তেই কলকাতায় আসেন সুব্রত। ভর্তি হন শিয়লাদার বঙ্গবাসী কলেজে। আর সেখানেই কংগ্রেসের ছাত্র রাজনীতিতে অভিষেক এবং প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। যে ঘনিষ্ঠতা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে কার্যত মিথে পরিণত হয়। সত্তরের ওই আগুন সময়ে ‘প্রিয়-সুব্রত’ জুটি বাংলার ছাত্র রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। ‘প্রিয়দার’ নেতৃত্বেই রাজ্যের জেলায় জেলায় ছুটলেন সংগঠন তৈরির কাজে।
১৯৭১ সালে বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হলেন। তখন সুব্রত মুখার্জি ২৫ বছরের যুবক। জীবনে প্রথম ভোটে লড়ে জয় ছিনিয়ে নিলেন। এরপর ১৯৭২ সালে ফের বালিগঞ্জ থেকে ভোটে জয়ী হলেন সুব্রত। সে বছরই জায়গা পেলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রীসভায়। মাত্র ২৬ বছর বয়সে মন্ত্রী হয়ে রাজ্যের কনিষ্ঠতম মন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড গড়লেন, যা আজও অটুট।
সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে সুব্রত মুখার্জি জানিয়েছিলেন, তখন খাতায় কলমে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী হলেও ১৩ টি দফতরের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় নিজে হাতে করে তাঁকে প্রশাসনিক কাজ শিখিয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের ভরাডুবিতে নিজেও ভোটে হারেন। এবং পরে ১৯৮২ সালে উত্তরকলকাতার জোড়াবাগান কেন্দ্রে থেকে জয়ী হয়ে ফের বিধানসভায় ফেরেন। পরপর তিনবার ওই কেন্দ্র থেকেই বিধায়ক হন তিনি। এরপর ১৯৯৬ চৌরঙ্গি থেকে প্রার্থী হন। কেন্দ্র বদল হলেও তাঁর জয় অব্যাহত থাকে।
শ্রমিক সংগঠন নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে মতানৈক্যের জেরে ২০০০ সালে হাত শিবির ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি। প্রসঙ্গত, আজকের মুখ্যমন্ত্রীর সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ কার্যত সুব্রত মুখার্জির হাত ধরেই।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যখন যোগমায়া দেবী কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী, সুব্রত মুখার্জি সেই সময় ছাত্র পরিষদের সভাপতি। একদিন ডেকে পাঠালেন মমতা ব্যানার্জিকে। তাঁর কাজের প্রশংসা করার সঙ্গে সঙ্গে আরও বড় পরিসরে রাজনীতি করার জন্য মমতাকে আহ্বান জানালেন তিনি।
এরপর ১৯৮৪ সালে সিপিএমের হেভিওয়েট প্রার্থী সোমনাথ চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে প্রার্থী খুঁজছে কংগ্রেস। সেই সময় রাজীব গান্ধী প্রণব মুখার্জিকে বলেছিলেন যাদবপুরের জন্য কোনও লড়াকু প্রার্থীকে টিকিট দিতে। প্রণব মুখার্জির কাছে মমতা ব্যানার্জির নাম সুপারিশ করেছিলেন সুব্রত মুখার্জি। মমতা ব্যানার্জিই যে যাদবপুরের জন্য যোগ্যতম প্রার্থী তা প্রণব মুখার্জির কাছে জোড় গলায় জানিয়েছিলেন সুব্রত।
২০০০ সালে কংগ্রেস বিধায়ক থাকাকালীন তৃণমূলের টিকিটে পুরভোট লড়ে কলকাতার মেয়র হন তিনি। অনেকের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে সুব্রত মুখার্জিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ মেয়র। এক কথায় কলকাতা শহরকে ঢেলে সাজিয়ে ছিলেন। তিনি মেয়র থাকাকালীন কলকাতা পুরসভার অন্যতম কাজ, শহরের জায়গায় জায়গায় পথচারীদের জন্য শৌচাগার তৈরি। রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে উন্নয়নের কাজে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মেয়র থাকাকালীনই শেষের দিকে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য তৈরি হয়। এবং যার ফলে তৃণমূল ছাড়েন।
এরপর কংগ্রেসে থাকাকালীন ২০০৮ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে সিঙ্গুরে মমতার ব্যানার্জির ধর্ণা মঞ্চে গিয়ে হাজির হন।২০১০ ফিরে আসেন তৃণমূলে। এবং ২০১১ সালে তৃণমূলের টিকিটে সেই বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকেই বিধায়ক হন সেই সঙ্গে মমতার মন্ত্রী সভায় জায়গা পান। এবং এই বালিগঞ্জ কেন্দ্রের বিধায়ক থাকাকালীনই প্রয়াত হলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক।
ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন। দিল্লির রাজনৈতিক মহলে প্রভাব থাকলেও ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সংসদের সদস্য হওয়া হয়নি। ঘনিষ্ঠমহল যা নিয়ে দুঃখ করতেন। তিন-তিন বার লোকসভা ভোটে দাঁড়ালেও প্রত্যেকবারই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে কংগ্রেসের টিকিটে লোকসভা ভোটে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। এরপর ২০১৯ সালে তৃণমূলের টিকিটে বাঁকুড়া থেকে ভোটে দাঁড়ান, এবারেও বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকারের কাছে পরাজিত হন তিনি। ২০০৬ সালে কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভার প্রার্থী হয়েও জিততে পারেননি। বর্ণময় রাজনৈতিক সফরে সাংসদ না হওয়ার বেদনা নিয়েই না ফেরার দেশে চলে গেলেন সুব্রত মুখার্জি।
Comments are closed.