কার্ফু। কথাটা শুনলেই কানে ভাসে পুলিশের ভারি বুটের আওয়াজ। জনমানবহীন রাস্তায় চারপাশে কড়া নজর রাখতে রাখতে অস্ত্র উঁচিয়ে দলবদ্ধভাবে হেঁটে যাচ্ছেন একদল খাঁকি উর্দিধারী।
জনরোষ নিয়ন্ত্রণ করে আইনের শাসন জারিতে কার্ফুর মার নেই। কিন্তু ইদানিং আরও একটি শব্দবন্ধ তোলপাড় ফেলেছে জনজীবনে। ভার্চুয়াল কার্ফু। বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসনের তরফে জারি হয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল কার্ফু। যার মানে ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন এক অবস্থা, যেখানে কাজ করবে না হোয়াটসঅ্যাপ সহ কোনও সোশ্যাল মিডিয়া, করা যাবে না ফোন বা এসএমএস। সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, যে কোনও ভয়াল সংঘর্ষ কিংবা আইন-শৃঙ্খলা প্রশ্নে অনুঘটকের কাজ করছে সোশ্যাল মিডিয়া। সেখানে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন তথ্য। সত্যি-মিথ্যা যাচাই না করেই তা নিয়ে মেতে উঠছেন সাধারণ মানুষ। আর তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে জনজীবনে।
এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠছে, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্লোগান তোলা দেশে ভার্চুয়াল মাধ্যমকে আটকে রাখার বাস্তবতা কতটা? সত্যিই কি তাতে আটকানো যাচ্ছে গুজবের ছড়িয়ে পড়া? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হল, ভার্চুয়াল কার্ফু জারি করে গুজব ছড়িয়ে পড়া না হয় কিছুটা আটকানো গেল, কিন্তু তাতে অন্যান্য ক্ষেত্রে কো-ল্যাটারাল ড্যামেজের দায় নেবে কে?
এই প্রশ্ন উঠছে কারণ, নোটবন্দির ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী মোদী জোর দিয়ে বলেছিলেন ডিজিটাল ইকনমি বা নগদহীন লেনদেনের কথা। পরবর্তীতে এই সুরেই কথা বলেছেন কেন্দ্রের সমস্ত মন্ত্রী। মোদী সরকারের ঘোষিত লাইনও তাই। এবার ভেবে দেখুন, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকলে কীভাবে অনলাইন লেনদেনের সুবিধা আপনি নেবেন? অর্থাৎ গুজব রুখতে ভার্চুয়াল কার্ফু জারি করে স্থানবিশেষে কি ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্লোগানকেই বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হচ্ছে না? সম্প্রতি গুজরাতে করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, হার্দিক প্যাটেলের পাতিদার আন্দোলনের সময় পুলিশ প্রশাসন টেলিফোন-ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখে। এর জেরে পুলিশ হিংসাত্মক আন্দোলন কিছু পরিমাণে রুখে দিতে সক্ষম হলেও ব্যবসায়ীরা এর জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। এতে উল্টে হার্দিকের প্রতি ব্যবসায়ী সমাজের সমর্থন বেড়ে যায় বহুগুণ।
ভারতের জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। তার মধ্যে অর্ধেক মানুষের বাড়িতে টিভি বা কম্পিউটার নেই। অর্থাৎ, প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ইন্টারনেট ও খবর জানতে একমাত্র অবলম্বন মোবাইল ফোনটিই। সেই মোবাইলকেই বিকলাঙ্গ করে রাখলে, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই খবর জোগাড়ের অন্য সূত্র খুঁজবে।
এরপর আসুন কাশ্মীর কিংবা ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খনি এই সমস্ত এলাকায় অশান্তির ঘটনাও নিত্যনৈমেত্তিক। অশান্তির ঘটনায় লাগাম পড়াতে ভার্চুয়াল কার্ফু জারি করাও এখানে কার্যত গা সওয়া। কিন্তু গুজব রুখতে ভার্চুয়াল কার্ফুর জেরে ব্যবসা কিংবা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কতটা প্রভাব পড়ছে তা এখন রীতিমতো গবেষণার বিষয়। একই চিত্র দেখা গিয়েছিল ধর্ষক রাম রহিমের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার দিন। পঞ্জাবের সিরসায় রাম রহিম ভক্তদের তাণ্ডবে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল এই জনপদ। অতঃপর ভার্চুয়াল কার্ফু এবং তারপর কার্ফু। গোলমাল রুখে দিয়েছিল প্রশাসনের এই পদক্ষেপ। যদিও প্রাথমিকভাবে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষতি কিন্তু রোখা যায়নি।
এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি আমরা আদৌ ডিজিটাল ইকনমি গ্রহণ করার মতো জায়গায় পৌঁছেছি? নাকি তাড়াহুড়ো করে তা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের উপর? সমাজ এর ভার বইতে পারবে তো? আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের প্রাথমিক পদক্ষেপই যদি হয় মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা, তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর সহজবোধ্য। গুজব ছড়ানোর কারণগুলোকে চিহ্নিত না করে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া, সাময়িকভাবে অত্যন্ত উপযোগী মনে হলেও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রকৃত অর্থেই ডিজিটাল ইন্ডিয়া হয়ে ওঠার পথে এটাই কি সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা নয়?
ভার্চুয়াল কার্ফু ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা বাক্ স্বাধীনতার পক্ষে যে ক্ষতিকর তা যেমন ঠিক, তেমনই বিশ্বের দরবারে নিজেকে ডিজিটাল সম্রাট হিসেবে তুলে ধরার মোদীর স্বপ্নপূরণের পক্ষেও মস্ত বড় বাধা। সেই বাধাকে টপকে মোদীর ভারত কি পারবে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার হাত ধরে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিতে? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
Comments are closed.