সাধারণত আমানতকারীর একাধিক সন্তান থাকলে, তাঁদের একজনকে ‘নমিনি’ হিসাবে ঘোষণার চল আছে। এছাড়া স্ত্রীকেও কেউ নমিনি করতে পারেন। এই ব্যাপারটি কিন্তু আইনি জটিলতা তৈরির জন্য নয়। বরং তা থেকে মুক্তির জন্য। কিন্তু ভারতে ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস ইত্যাদিতে এমন বহু আমানত আছে যা নমিনির অভাবে আমানতকারীর অবর্তমানে তার পরিবারের হাতে পৌঁছয়নি। আপনার অবর্তমানে কষ্টার্জিত সম্পদ যাতে সঠিক সময় সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছয় তার জন্যই নমিনি করা। কিন্তু এ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ও জ্ঞানের অভাবে অনেকেই ভুল করে বসেন। তাই নমিনি নিয়ে একটা ধারণা তৈরি করতেই এই প্রতিবেদন।
পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড (PPF) খোলার পর নমিনির নাম ডিজিটালাইজড করেছেন তো?
আমরা যখন প্রথম PPF খুলেছিলাম সেখানে কেউ কেউ নমিনি রেখেছি, কেউ রাখিনি। এখন বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে আগে নমিনি বসানো সত্ত্বেও প্রভিডেন্ট ফান্ড ডিজিটাল হওয়ার পর তার উল্লেখ নেই। তাই ঝামেলা এড়াতে শীঘ্রই ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসে গিয়ে ‘নমিনি’ কে হবেন তা আপডেট করুন। এভাবেই FD, পলিসি সহ বিভিন্ন বিনিয়োগেই আমরা নমিনি রাখতে কিংবা তা আপডেট করতে ভুলে যাই। তাই প্রতিবছর রিভিশন করে দেখে নিন আপনার নমিনি ঠিক আছে কিনা।
নমিনি রাইট সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন
আমরা সবাই জানি ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ব্যবসায়িক মালিকানা আইনগতভাবে ভিন্ন। ব্যবসায় ওঠানামা থাকে, পরিবারে তা নেই। ব্যবসায় রিস্ক শেয়ার হয়, পরিবারে হয় না। সেখানে পরিবারের কর্তা বা কর্ত্রীর উপর বর্তায়। ব্যবসার উদ্দেশ্য অধিক লাভ আর পারিবারিক উদ্দেশ্য কীভাবে সুখ, শান্তিকে ম্যাক্সিমাইজ করা যায়। এই কথাগুলো বলছি একটাই জিনিস বোঝাতে যে, আমার ব্যবসাকে আমি যে কোনও সময় বিক্রি করে দিতে পারি, বন্ধও করে দিতে পারি কিন্তু পরিবারের ক্ষেত্রে তা সম্ভব কি? একটা পরিবারের বাচ্চা বলতে পারে না, তার বাবার বিনিয়োগ, সঞ্চয়ের পরিমাণ কত বা কোথায় রাখা আছে। সেটা তার কৌতূহলের জায়গাও নয়। তাই পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা, তা ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় এবং ঠিক পরিমাণে পৌঁছবে কিনা, সেটা বোঝার দায়িত্ব থাকে পরিবারের কর্তা বা কর্ত্রীর উপর। আর সেখান থেকেই আসে নমিনির গুরুত্ব।
অ্যাসাইনমেন্টের ভূমিকা: অ্যাসাইনমেন্ট দু’ধরনের হতে পারে। এক, অ্যাবসোলিউট অ্যাসাইনমেন্ট। যেখানে মালিকের অবর্তমানে তাঁর সম্পত্তির পুরোপুরি ভাগ তিনি দিয়ে যাচ্ছেন নমিনিকে।
দুই নম্বর হল, কন্ডিশনাল অ্যাসাইনমেন্ট। সেখানে রয়েছে দুটি ভাগ। ১) মনিটরি কনসিডারেশন অ্যাসাইনমেন্ট: কোনও ঋণ নেওয়ার পর যতদিন তা শোধের প্রক্রিয়া চলছে ততদিনের জন্য শর্তসাপেক্ষে আমি আমার এফডি অথবা শেয়ার ইত্যাদির কাগজ ঋণদাতার কাছে জমা রাখলাম। শোধের পর তা আবার আমার কাছে ফিরে এল। এটাই মনিটরি কন্ডিশনাল অ্যাসাইনমেন্ট।
২) লাভ অ্যান্ড অ্যাফেকশন কনসিডারেশন অ্যাসাইনমেন্ট: ছেলে অ্যাসাইনমেন্ট এভাবে করলেন, যতদিন বাবা বা মা জীবিত থাকবেন, ততদিন একটি নির্দিষ্ট সম্পত্তি আমি তাঁদের ট্রান্সফার করলাম। কিন্তু তাঁদের অবর্তমানে এবং সই ছাড়া তা ছেলের কাছে ফিরে আসবে।
এছাড়াও রয়েছে ম্যারেড উইম্যান্স প্রোপার্টি অ্যাক্ট বা WMP অ্যাক্ট। যেখানে কোনও ইন্সিওরেন্স পলিসি ডব্লুএমপি অ্যাক্টে স্ত্রী ও সন্তানের নামে কেউ করে দিতে পারেন। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি যদি দেউলিয়া ঘোষিত হন তারপরেও ওই সম্পত্তিতে কেউ হাত দিতে পারবে না। তাই ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এই ডব্লুএমপি অ্যাক্টে ইন্সিওরেন্স করে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট করা যায় এবং কোথায় করা যায় না?
এলআইসির ক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট করা যাবে। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে তা হয় না। শেয়ারের ক্ষেত্রে ট্রান্সফারের মাধ্যমে গিফট করা যেতে পারে কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট করা যায় না। ইপিএফ, পিপিএফের ক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট করা যাবে না। এফডি-র ক্ষেত্রে করা যাবে কিন্তু শর্ত থাকবে।
সাধারণত আমাদের কত রকম সম্পত্তি হতে পারে এবং কে হতে পারে নমিনি?
সাধারণভাবে আমরা সম্পত্তি রাখি জীবন বিমা, মিউচুয়াল ফান্ড, শেয়ার, ইপিএফ, পিপিএফ, সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, কারেন্ট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ফিক্সড ডিপোজিট ও রেকারিং ডিপোজিটে। এবার কোথায় কাকে নমিনি রাখা যায় জেনে নেওয়া যাক।
লাইফ ইন্সিওরেন্সের ক্ষেত্রে বেনিফিশিয়ারি নমিনি হতে হবে। যাতে বিমার পুরো অঙ্কটাই তাঁর কাছে ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারে।
ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতে নমিনির ভূমিকা কী?
ব্যাঙ্ক, মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে নমিনির ভুমিকা হল ট্রাস্টির মত। অর্থাৎ, নমিনির কাজ হল যখন অ্যাকাউন্ট হোল্ডার মারা যাবেন তখন তিনি ওই অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ করবেন (যেমন, অ্যাকাউন্টে রক্ষিত টাকা তোলা) এবং সম্পত্তিটি অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। শেয়ারের ক্ষেত্রেও আগে নিয়ম মেনে ট্রান্সফার করতে হবে। লাইফ ইন্সিওরেন্স ছাড়া একমাত্র ইপিএফের ক্ষেত্রে নমিনি ওনার (owner) হতে পারে। বাকিগুলোতে রিসিভার হতে পারেন। অনেকেই নমিনি ও রিসিভারের যে বিরাট ফারাক আছে তা বুঝতে পারেন না। ধরা যাক, কারও তিন ভাই। মায়ের পর নমিনি হিসেবে কোনও এক সন্তানের নাম থাকলে তিনি রিসিভ করলেন। তার মানে কিন্তু এই নয় যে ওই ভাই তিনি ওনার (owner) হলেন। তিনি কেবল রিসিভার। আর একটা জিনিস বলে রাখি। কেবল এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড (EPF) এবং লাইফ ইন্সিওরেন্সের ক্ষেত্রে নমিনিই ওনার হতে পারেন।
লাইফ ইন্সিওরেন্সে নমিনির প্রকারভেদ
লাইফ ইন্সিওরেন্সের ক্ষেত্রে মোট পাঁচ রকমভাবে আমরা নমিনি করতে পারি। এগুলো হল মাল্টিপল, পারসেন্ট ওয়াইজ, কনজিকিউটিভ, অল্টারনেট নমিনি ও সিঙ্গল নমিনেশন।
কোন কোন আইনে কী নমিনি?
লাইফ ইন্সিওরেন্সের ক্ষেত্রে ইন্সিওরেন্স অ্যাক্ট ১৯৩৯ এর ৩৯ ধারায় নমিনি করা হয়। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে আন্ডার সেকশন ২৯ এ অফ এডিবি, এম এস রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৬৮, শেয়ারের ক্ষেত্রে ১৯০ অফ কোম্পানিজ অ্যাক্ট অ্যান্ড সেকশন ৯.১১ অফ ডিপোজেটরি অ্যাক্ট। পিপিএফের ক্ষেত্রে সেকশন ১২, পিপিএফ স্কিম, ১৯৬৮, জিএসআর ১১৩৬। ইপিএসের ক্ষেত্রে সেকশন ২ ফ্রম ২ অফ ইপিএফও ইন্ডিয়া, মিনিস্ট্রি অফ লেবারস। আর ফিক্সড ডিপোজিট, রেকারিং ডিপোজিট ইত্যাদির নমিনির ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে আন্ডার সেকশন ৪৫ জেডএ অফ ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্টের দিকে।
(লেখক বিশিষ্ট ফিনান্সিয়াল প্ল্যানার। বিমা বা বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে কোনও পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করুন: 98363 74487, 98356 66559, [email protected])
Comments are closed.