করোনা-হানায় ত্রস্ত বিশ্ব। ১১৪ টি দেশে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯-কে ‘প্যানডেমিক’ বা অতিমারি হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। করোনার ছোবলে বিশ্বজুড়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের মৃত্যু, আক্রান্তের সংখ্যা ১২ লক্ষ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বুধবার একে প্যানডেমিক ঘোষণা করায় বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়েছে, টালমাটাল অর্থনীতি। কিন্তু কী এই প্যানডেমিক? এর আগে কতবার এই অতিমারি হয়েছে?
প্যানডেমিক কী?
প্যানডেমিক বা অতিমারি ঠিক কী, এই প্রশ্নই এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব কম সময়ের মধ্যে কোনও রোগ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লেই তাকে প্যানডেমিক বলা হয় না। যেমন, ২০১৯ সালে আমেরিকায় এক প্রকার হাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৯২ সালে এর সংক্রমণ দেখা গেলেও ২০১৯ সালে তা মাত্রা ছাড়িয়েছিল। কিন্তু ভ্যাকসিন থাকার জন্য তা ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। করোনাভাইরাসের মতো এত ভয়ঙ্কর রূপও নেয়নি। এখানেই এপিডেমিক ও প্যানডেমিকের মধ্যে পার্থক্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারীকে যে ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তা হল কোনও অসুখ যখন স্বাভাবিকতা ছাড়িয়ে একটি সম্প্রদায় বা অঞ্চলকে আক্রমণ করে তখন তা মহামারী। কিন্তু প্যানডেমিক এর থেকে আলাদা। ‘এ ডিকশনারি অফ এপিডিমায়োলজি’ অনুযায়ী, প্যানডেমিক হল এমন এক মহামারি যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, অথবা আন্তর্জাতিক সীমানা ছাড়িয়ে কোনও বিশাল এলাকাজুড়ে প্রচুর মানুষকে আক্রমণ করে। সহজ ভাবে বললে, মহামারীর চেয়েও যা আরও বেশি ভয়াবহ, তা-ই হল প্যানডেমিক। এই বিষয়ে বলে রাখা প্রয়োজন, চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, কোনও অসুখ কতটা ভয়াবহ, তার উপর প্যানডেমিক ঘোষণা নির্ভর করে না। কোনও অসুখ বিশ্বের কতটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এবং তার হার কেমন ইত্যাদি বিবেচনা করার পর প্যানডেমিক ঘোষণা করা হয়।
কখন প্যানডেমিক ঘোষণা হয়?
জেনিভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র ডিরেক্টর জেনারেল টেডরস আধানম গোবিয়াসেস জানান, করোনাভাইরাসের কারণে এই প্রথমবার প্যানডেমিক বা অতিমারি হল। এর আগেও করোনাভাইরাস বিপজ্জনক ছিল কিন্ত তা প্যানডেমিক বা অতিমারির আকার নেয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই সিদ্ধান্ত নেয় কোনও অসুখ বা রোগকে প্যানডেমিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে কি না। কটি দেশ আক্রান্ত হচ্ছে, কতজন মারা যাচ্ছে বা কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, শুধু তার উপর নির্ভর করেই প্যানডেমিক ঘোষণা হয় না। আরও বেশ কিছু জিনিস বিশ্লেষণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ২০০৩ সালে সার্স করোনাভাইরাস ২৬ টি দেশের উপর প্রভাব ফেললেও তাকে প্যানডেমিক বলেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
করোনাভাইরাসের আগে আর কোন রোগকে প্যানডেমিক ঘোষণা করা হয়েছে?
২০০৯ সালে এইচ ওয়ান এন ওয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সোয়াইন ফ্লু-কে প্যানডেমিক ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো অত ভয়ঙ্কর হয়নি সোয়াইন ফ্লু। এই রোগে গড় মৃত্যুহার ছিল ০.০২ শতাংশ, মৃতের সংখ্যা বেশি হলেও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সে ভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি ওই রোগ। বিশ্বের ১১ থেকে ২১ শতাংশ মানুষ এই প্যানডেমিকে প্রভাবিত হয়। ২০০৯ সালে আমেরিকায় প্রথম সোয়াইন ফ্লু কারমণ করে। ২০০৯ সালের ১১ জুন একে প্যানডেমিক ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২০০৯ সালের ১০ অগাস্ট প্যানডেমিক শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। সোয়াইন ফ্লুর প্রথম বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০ থেকে ৪০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। ভারতে প্রথম হায়দরাবাদে ধরা সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়েছিল। ২০১০ সালের ৮ অগাস্ট কেন্দ্রীয় সরকার একটি রিপোর্টে জানায় মোট ১,৮৩৩ জন মানুষের মৃত্যু হয় এই সোয়াইন ফ্লুয়ে।
এরপরেই ২০২০ সালে করোনাভাইরাসকে অতিমারি বলে ঘোষণা করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এখনও পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে চার হাজারের বেশি। ভারতে মৃত্যু হয়েছে একজনের। কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩।
স্প্যানিশ ফ্লু এ (এইচওয়ান এনওয়ান)
এ ছাড়া ইতিহাস বলছে, চারবার প্যানডেমিকে আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন দেশ। তবে তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণায় নয়। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু (এইচওয়ান এনওয়ান)-কে প্যানডেমিক বলা চলে। বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এই স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জায় প্রভাবিত হয়েছিল। ওই বছর গোটা ইউরোপ ও আমেরিকা ব্যতিব্যস্ত হয়েছিল এই ইনফ্লুয়েঞ্জায়। মোট দুই পর্যায়ে এই ভাইরাস ছড়িয়েছিল। সব মিলিয়ে ২ থেকে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।
এশিয়ান ফ্লু এ (এইচটু এনটু)
১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এশিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (এইচ টু এন টু)মহামারির থেকেও ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছিল। ব্রিটেনে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এবং বিশ্বব্যাপী ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় এই এশিয়ান ফ্লুতে।
হংকং ফ্লু এ (এইচ থ্রি এন টু)
১৯৫৭ সালের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর হলেও ভিয়েতনামের যুদ্ধবাহিনীর কাছ থেকে ছড়ানো এই ভাইরাসের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তে মাত্র তিন মাস সময় লেগেছিল। শুধু ইংল্যান্ডেই মারা যায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ এবং বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষেরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই প্যানডেমিক বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারেনি। কারণ, ১৯৫৭ সালের ফ্লু এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে একরকম অনাক্রমণতা তৈরি করতে পেরেছিল
এইচআইভি/এইডস
১৯৮১ সালে প্রথম এইচআইভি চিহ্নিত হয়। লস এঞ্জেলসের পাঁচজন যুবকের দেহে এই এইচআইভি পাওয়া যায়। যদিও একই সময়ে নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়াতেও এইচআইভি আক্রান্তের খবর উঠে আসে বলে ভিন্নমত রয়েছে। সে বছর প্রায় ১২১ জন সমকামী পুরুষের মৃত্যু হয়। তবে ১৯৮২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় এইডস আক্রান্তের খবর ছড়ায়। এরপর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে এইডস আক্রান্তের খবর আসে। যে ভাইরাস এখনও ছড়াচ্ছে । ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ এইচআইভি/ এইডসে আক্রান্ত।
Comments are closed.