দিনে রিকশাওয়ালা, রাতে গামছা পেতে ঘুম! এবার ভোটের লড়াইয়ে দলিত সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী

‘বর্তিকা’ পত্রিকা দিয়ে শুরু মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখক জীবনের

৫ মার্চ কালীঘাটের অফিস থেকে মমতা ব্যানার্জি একুশের হাইভোল্টেজ নির্বাচনে ২৯১ টি আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন। তালিকায় ছিল একাধিক চমক। তবে সবথেকে বড় চমকটার নাম হয়ত মনোরঞ্জন ব্যাপারী। বলাগড় বিধানসভা থেকে ঘাসফুল চিহ্নে ভোট ময়দানে নামছেন লেখক তথা পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য একাডেমির সভাপতি মনোরঞ্জন। ছেলেবেলা গরু চড়ানো থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা, বেঁচে থাকতে এরকম একাধিক কাজ করেছেন যে মানুষটি, তিনিই বিধানসভার প্রার্থী।

একটি সাক্ষাৎকারে হাসতে হাসতে নিজেই বলেছিলেন, মা বাবা তাঁর জন্মের তারিখ জানতেন না। সমাজের যে স্তর থেকে উঠে এসেছেন সেখানে এসবের চল ছিল না। জন্মেছেন পদ্মার ওপারে বরিশালে। জ্ঞান হওয়ার আগেই মা বাবা তাঁকে নিয়ে চলে আসেন এপার বাংলায়।
ছোটবেলা কেটেছে বাঁকুড়ার এক রিফিউজি ক্যাম্পে। ফেসবুকে লিখেছেন রিফিউজি ক্যাম্পের দিনগুলো জেল খাটার মতো ছিল। উদ্বাস্তু কলোনির বন্দি জীবন পিছু ছাড়েনি তাঁর। বাঁকুড়ার ক্যাম্প থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘুটিয়ারি শরিফের ঘোলদলতলা রিফিউজি ক্যাম্পে কাটান ১৯৬৯ পর্যন্ত। এরপর ঘোলদলতলা থেকে মনোরঞ্জন ব্যাপারী ও তাঁর পরিবারকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ঠাঁই হয় দণ্ডকারণ্যে।

১৯৭৩ পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে কলকাতায় আসেন তিনি। তারপর থেকে যখন যা কাজ পেয়েছেন করেছেন। রাতে প্ল্যাটফর্মে শুয়েছেন গামছা পেতে। এভাবেই কেটে যেতে পারত বাকি জীবনটা। কলকাতার আর পাচঁটা ফুটপাথবাসীর ভিড়ে তিনিও হয়ত হারিয়েই যেতেন। কিন্তু এই দলিত লেখকের অন্য পরিকল্পনা ছিল। রাজনীতির অ, আ, ক, খ শেখার পর আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়েন নকশাল আন্দোলনে। গ্রেফতার হয়ে ঠাঁই হয় জেলখানায়। আবার শুরু বন্দি জীবন। আর এখানেই এক ধাক্কায় বদলে গেল মনোরঞ্জন ব্যাপারীর জীবন। জেলে এক নকশাল নেতার সহযোগিতায় শিখলেন পড়াশোনা। জেলের দেওয়ালে খড়িমাটি দিয়ে দাগ কেটে কেটে চিনতে শিখলেন অক্ষর।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রিক্সা চালানো শুরু করলেন। দিনে রিক্সা চালানো, আর রাতে বই পড়া। এই রিক্সাই মনোরঞ্জনের জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন আনল। তাঁর রিক্সাতেই কলেজে যাওয়া আসা করতেন সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। একদিন মহাশ্বেতা দেবীকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন একটি শব্দের মানে। একজন রিকশাচালকের মুখে অপরিচিত বাংলা শব্দ শুনে বেশ অবাক হয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তারপর কথায় কথায় মহাশ্বেতা জানতে পারেন তাঁর বই পড়ার নেশার কথা। মনোরঞ্জনকে তিনি ‘বর্তিকা’ পত্রিকায় লেখার কথা বলেন। মনোরঞ্জনের মত মানুষদের জন্যই ওই পত্রিকা করতেন মহাশ্বেতা দেবীরা। ‘বর্তিকা’ পত্রিকা দিয়ে শুরু তাঁর লেখক জীবনের। তারপর একে একে লিখে ফেলেছেন বেশ কয়েকটি উপন্যাস, একাধিক ছোটো গল্প, প্রবন্ধ । 

[আরও পড়ুন- চাল দেব বিনা পয়সায়, গ্যাস কিনতে হবে ৯০০ টাকায়! ডোরিনা ক্রসিং থেকে মোদীকে তোপ মমতার]

 জীবনের প্রথম আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন এনে দিয়েছে জাতীয় স্তরের একাধিক পুরস্কার। এখন একাধিক ভাষায় অনুবাদ হয় তাঁর লেখা। ২০১৪ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। পাশাপাশি দেশ-বিদেশে সমাদৃত তাঁর লেখা। জার্মানি দিয়েছে ‘রুশো ফেলোশিপ’। দেশের যে কোনও প্রথম সারির সাহিত্য সভায় ডাক পান একদা গামছা পেতে প্লাটফর্মে রাত কাটানো লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী।

এবার নতুন লড়াই। রাজনীতির ময়দান কি সাহিত্যের মতোই সমৃদ্ধ করবে মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে? উত্তর দেবে সময়। কিন্তু আদ্যন্ত সংগ্রামী মানুষটা এবারে এমন এক নির্বাচনী ময়দানে যার ফলাফলের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ।

Comments are closed.