ফিরহাদ হাকিমের মেয়ের পর এনআরএস কাণ্ড নিয়ে সেলিমের ছেলের নিজেকে ‘মুসলিম’ বলে ফেসবুক পোস্ট, এবার অস্বস্তিতে সিপিএম
এনআরএস কাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে তৃণমূলের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের মেয়ে শাবা হাকিম। এবার এই ঘটনা নিয়ে ফেসবুক পোস্টে নিজেকে ‘মুসলিম’ বলে ঘোষণা করে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নয়া অস্বস্তি তৈরি করলেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের ছেলে রাসেল আজিজ। বিশেষ করে, বিজেপি এবং তৃণমূল দু’দলই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি করছে বলে সিপিএম যখন বারবার অভিযোগ তুলছে, সেখানে সদ্য প্রাক্তন সাংসদ এবং পলিটব্যুরো সদস্য সেলিমের ছেলের নিজেকে ‘মুসলিম’ ঘোষণা করে ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে ফেসবুক পোস্ট দলের জন্য নতুন বিড়ম্বনা তৈরি করল বলেই মনে করছেন সিপিএম নেতৃত্ব।
রাসেল আজিজ লিখেছেন, আমি একজন মুসলিম। যারা চিকিৎসকদের মারধর করেছে, তারা যে ধর্মেরই হোক তাদের শাস্তি দাবি করছি। এই ইস্যুর ধর্মীয়করণ বন্ধ হোক। চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়ান।
এনআরএস কাণ্ডে প্রথম ধর্মীয় অ্যাঙ্গেল এনেছিলেন বিজেপি নেতা মুকুল রায়। তিনি বলেছিলেন, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তারপর রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ সরাসরিই মুসলিম সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে এই ঘটনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। যদিও চিকিৎসকদের আক্রমণকারীদের একমাত্র ‘দুষ্কৃতী’ ছাড়া আর কোনও পরিচয় হতে পারে না, এ কথাই সরকারিভাবে মত সিপিএমের। অথচ ফেসবুকে বিভিন্ন সময় সিপিএমের পক্ষে রাজনৈতিক পোস্ট করা এবং দলের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের ছেলে রাসেল কেন নিজেকে ‘মুসলিম’ বলে ঘোষণা করে এই ইস্যুতে ধর্মীয় তত্ত্ব আনলেন, তা অনেক সিপিএম নেতার কাছেই স্পষ্ট নয়।
লোকসভা ভোটের বিপর্যয়ের পর গত ৪ ই জুন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠক বসেছিল। সেখানে জবাবি ভাষণে দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, সিপিএমের বাইরের অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন মন্তব্য করছেন, যা দলের ক্ষতি করছে। কিন্তু দলের ভেতরে আছেন এমনও কারও কারও সোশ্যাল মিডিয়ায় করা মন্তব্য সমস্যা সৃষ্টি করছে। প্রসঙ্গত, নির্বাচন চলাকালীন কলকাতার সিপিএম নেতা শতরূপ ঘোষ ‘মধ্যমা’র ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন, যা নিয়ে দলের অন্দরে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
সেটা ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ, রাজ্যে জনগণনা শুরুর দিন। রাজ্য জনগণনা দফতরের পদস্থ আধিকারিক সকাল ৯ টা নাগাদ পৌঁছেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে। এই সাংবাদিক তখন আজকাল পত্রিকায় কর্মরত। বুদ্ধদেববাবুর বাড়িতে সকালে জনগণনা দফতরের অফিসার যাবেন, আগের রাতে এই খবর পেয়ে সেদিন সকালে পৌঁছে গিয়েছিলাম পাম অ্যাভেনিউয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি ফ্ল্যাটে। সঙ্গী ক্যামেরাম্যান অমিত ধর। জনগণনা দফরের আধিকারিক নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে বুদ্ধদেববাবুর ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলেন। আমিও পিছন পিছন গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দরজায় কড়া নাড়লাম। বুদ্ধদেববাবুর মেয়ে দরজা খুলতে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, খবর করতে এসেছি। অনুরোধ করলাম, যদি ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায়। তিনি ভেতর থেকে জেনে এসে ঘরে ঢুকতে দিলেন।
ঘরে দাঁড়ানারও কার্যত জায়গা নেই। একটা খাবার টেবিলের পাশে চেয়ারে আড়ষ্টভাবে বসলাম। টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে জনগণনা দফতরের আধিকারিক ফর্ম ভর্তি করছেন। একের পর এক প্রশ্ন করছেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উত্তর দিচ্ছেন। নাম, বয়স, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্ত্রীর নাম, সন্তানের নাম নানা প্রশ্ন করতে করতেই সেই আধিকারিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ধর্ম’? গড়গড় করে উত্তর দিচ্ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, এই প্রশ্ন হতেই এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘আমার কোনও ধর্ম নেই। এই সময় দাঁড়িয়ে ফর্মে ‘ধর্ম’ কলামটা কেন রেখেছেন আপনারা?’ জনগণনা দফতরের আধিকারিক থমকে গেলেন। মুখ তুলে বললেন, ‘স্যর, আছে, কী করব? ফর্মের তো কোনও পয়েন্ট খালি রাখা যায় না’।
‘না না, আমার কোনও ধর্ম নেই, ফাঁকা রাখুন’, ফের দৃঢ়ভাবে বললেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ‘ধর্ম’ কলামটা খালি রেখে ফর্ম ভর্তি হল। তারপর নীচে সই করে দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
তারপর দেড় যুগ কেটে গিয়েছে। সেই বছর ভোটে জিতে আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, ২০১১ সালে হেরেও গিয়েছেন। শারীরিক কারণে রাজনীতি থেকে কার্যত অবসর নিয়েছেন। সাংবাদিক হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে কখনও ইতিবাচক, কখনও নেতিবাচক আলোচনায় বহুবার অংশ নিয়েছি, কিন্তু তাঁর সেই উত্তর মাথার মধ্যে গেঁথে গেছে চিরকালের মতো।
আজ রাজ্যের এক কঠিন সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই কথাই আবার বারবার মনে পড়ছে, ‘আমার কোনও ধর্ম নেই’।
Comments are closed.