মধুবালা দাসকে না পেয়ে মধুবালা মণ্ডলকে ‘বিদেশি’ তকমা দিয়ে ৩ বছর অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পে, ভুল স্বীকার অসম বর্ডার পুলিশের
কাবুল যাওয়ার পথে ‘বাসের পেটে’ বসে সৈয়দ মুজতবা আলি শুনেছিলেন এক পয়তাল্লিশ নম্বরের কিস্যা। এক কয়েদি পালিয়ে যাওয়ায় রাজার প্রহরীরা রাস্তা থেকে একজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে, গোঁজামিল দিয়ে হিসেব মিলিয়েছিল। আর সেই ব্যক্তিও সৈন্যদের শিখিয়ে দেওয়া বুলিই আউড়ে গিয়েছিল বাকি জীবনটা। যাঁরা ভাবছেন এমন গপ্পো কেবল কাগজ-কলমের যুগলবন্দিতেই বেরোয়, তাহলে ভুল ভাবছেন। বাস্তবেও এমন সৈন্য বাহিনীর অস্তিস্ব আছে। আর তারা আছে বলেই এখনও প্রাসঙ্গিক পয়তাল্লিশ নম্বররা।
অসমে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে এখন সারাদেশে চর্চা। বুধবার আরও লক্ষাধিক নাম বাদ গিয়েছে খসড়া তালিকা থেকে। এই প্রেক্ষিতে এবার সামনে এল এক অসহায় পয়তাল্লিশ নম্বরের চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
২০১৬ সালে অসমের চিরাং জেলার বিষ্ণুপুর (১) গ্রামে ‘বিদেশি’ মধুবালা দাসকে ধরতে গিয়ে অসম বর্ডার পুলিশ ধরে নিয়ে আসে জনৈক মধুবালা মণ্ডলকে। হতদরিদ্র মধুবালা মণ্ডল বারবার বলেছিলেন পুলিশকে, তাদের কোনও ভুল হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মধুবালা মণ্ডলের ঠাঁই হয় কোঁকড়াঝাড় ডিটেনশন ক্যাম্পে। তারপর কেটে গিয়েছে তিন-তিনটি বছর। বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী মধুবালা মন্ডলের অনুপস্থিতিতে কী অবস্থা সংসারের? খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বাড়িতে থাকেন মধুবালার শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে। ৩ বছর তাঁর কীভাবে কাটল, কেউ জানে না।
কিছুদিন আগে বিষয়টি অসমের চিরাং জেলার সমাজকর্মীদের নজরে আসে। তাঁরা অসম প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করার জন্য আবেদন জানান। এরপর প্রশাসনের তদন্তে উঠে আসে, ‘ভুল’ করে এক গরিব, নিরক্ষর বৃদ্ধাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে কেটে গিয়েছে ৩ বছর। অসম বর্ডার পুলিশ নিজেদের ‘ভুল’ স্বীকার করে বৃহস্পতিবার বৃদ্ধা মধুবালা মণ্ডলকে মুক্তি দেয়।
জানা গিয়েছে, যে মধুবালা দাসের সন্ধানে পুলিশ গিয়েছিল, তাঁর মৃত্যু হয়েছে ২০১৬ র আগেই। কিন্তু বর্ডার পুলিশের কাছে সেই খবর ছিল না। তাই মধুবালা দাসকে খুঁজে না পেয়ে নিরক্ষর, হতদরিদ্র, অসহায় মধুবালা মণ্ডলকেই মধুবালা দাস নামে জুতে দিয়ে কাজ সেরেছে। এমনটাই বলছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
এই অবশ্য প্রথম নয়। কখনও কার্গিল যুদ্ধে লড়াই করা অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিক মহম্মদ সানাউল্লাকে বিদেশি বলে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া, আবার কখনও একটি পরিবার থেকে একজন মহিলাকে বিদেশি বলে দাবি করা, বিদেশি বাছতে এমন লজ্জাজনক ভ্রান্তির দৃষ্টান্ত অগুন্তি। অসম বর্ডার পুলিশ এই সংক্রান্ত সমস্ত তদন্তের কাজ করে। সেই তদন্তের ক্ষেত্রেই বিশাল মাপের গাফিলতি রয়ে গিয়েছে বলে দাবি অসমের মানবাধিকার কর্মীদের। একই কথা বলছেন সাধারণ মানুষও। কিন্তু এই ভুল তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকপঞ্জি তৈরি হলে আসল উদ্দেশ্য সাধিত হবে কি? প্রশ্ন উঠছে।
Comments are closed.