কর্মসূত্রে দেখা এক মর্মান্তিক ঘটনা, চাকরি ছেড়ে আদিবাসী মহিলাদের স্বনির্ভর করছেন সাংবাদিক সোনাল রোচানি

কন্যা ভ্রুণ হত্যা, পণের জন্য শ্বশুর বাড়িতে নিগ্রহ, মদ্যপ স্বামীর হাতে দিনের পর দিন নির্যাতন বা ‘নীচু জাত’ হওয়ার কারণে বিভিন্ন জায়গায় বঞ্চনার মতো সামাজিক ব্যাধি সম্পর্কে কম-বেশি সবাই ওয়াকিবহাল। আর নিজে একজন ক্রাইম রিপোর্টার হওয়ার সুবাদে এই খবরগুলি অন্যদের চেয়ে বেশিই জানতেন সুরাটের সোনাল রোচানি। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও চূড়ান্ত ব্যস্ততার কারণে, সমবেদনা জানানো ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করা হয়ে ওঠেনি এক নামী সংবাদমাধ্যমের ক্রাইম রিপোর্টার তাঁর। পেশার তাগিদে খবর সংগ্রহ গিয়ে ২০০৫ সালে এক ঘটনার সাক্ষী হন ক্রাইম রিপোর্টার সোনাল, যা তাঁকে নাড়িয়ে দেয়। গুজরাতের এক সরকারি হাসপাতালে আধপোড়া শরীর নিয়ে সোনালের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন এক গর্ভবতী মহিলা। গর্ভে কন্যা সন্তান থাকার কথা জানতে পেরে তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় শাশুড়ি। এই ঘটনা দেখার পর কয়েক রাত ঘুমোতে পারেননি সোনাল।
সিদ্ধান্ত নেন, কিছু করতে হবে এই পিছিয়ে পড়া, আদিবাসী মানুষগুলোর জন্য। অবশেষে মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে আদিবাসী ও গরিব মহিলাদের ক্ষমতায়নই লক্ষ্য হয়ে ওঠে সোনাল রোচানির।
বর্তমানে গুজরাতের ৫৫ টি গ্রামের প্রায় ৫ হাজার আদিবাসী মহিলার রুটিরুজি তৈরিতে বিশেষ সাহায্য করছেন এই প্রাক্তন সাংবাদিক। শুধু তাই নয়, ২০১১ সালে সোনালের তৈরি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘শক্তি ফাউন্ডেশন’ গরিব আদিবাসী মহিলাদের স্বনির্ভর করে তুলছে, শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষা দিচ্ছে, বিনামূল্যে বই, খাতা, কলম বিলি করছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা যাতে নিরক্ষর মানুষদের কাছে পৌঁছোতে পারে, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে যাতে তাঁরা ওয়াকিবহাল হন, তার সবরকম চেষ্টা করছে সোনালের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
সোনাল রোচানির প্রথম লক্ষ্য ছিল, দেশের নাগরিক হিসেবে সমস্ত প্রমাণপত্র যেন থাকে আদিবাসীদের। তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হয় সোনালের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এরপর গরিব ও আদিবাসী মহিলা ও শিশুর পুষ্টির অভাব দূর করা এবং মহিলাদের স্বনির্ভর করার দিকে নজর দেন সোনাল রোচানি।

লান্সেট গ্লোবাল হেলথ রিপোর্ট বলছে, মাতৃত্বকালীন অপুষ্টিতে ভোগা মহিলার সংখ্যা লক্ষ্যণীয়ভাবে বেশি গুজরাতে। আর গুজরাতের আদিবাসী সমাজে এই সমস্যা আরও বেশি। এই সমস্যা দূর করতে সোনাল নিজের পরিচিত চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সোনালের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তাঁরা বিনা পারিশ্রমিককে আদিবাসী মহিলা ও শিশুদের চিকিৎসা করেন। গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের জন্য সপ্তাহে দু’বার করে ঘি, ময়দা দিয়ে তৈরি ‘সুখদি’ আর ‘সিরা’ নামে খাবার দেওয়া হয় ‘শক্তি ফাউন্ডেশন’ থেকে।
সোনাল রোচানি তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অনেক সমস্যার মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হল, পুরুষদের তীব্র মদ-আসক্তি আর নির্বিচারে বনজঙ্গল ধ্বংসের কারণে নিজেদের পুরনো পেশা থেকে আদিবাসীদের বিচ্যুতি। সোনাল রোচানির কথায়, সস্তা মদ খেয়ে অল্প বয়সেই মৃত্যু হয় বাড়ির কর্তার। এরপর প্রবল আর্থিক সমস্যায় নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়া হয়। আর কয়েক বছর পেরোতে না পেরোতে এই নাবালিকারাই তিন, চার সন্তানের মা হয়ে একই সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সব মহিলাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করার জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি, বিভিন্ন হাতের কাজ শেখানো,পাঁপড় তৈরির পাশাপাশি ব্যবসার জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের ব্যবস্থা করে ‘শক্তি ফাউন্ডেশন’।
কিন্তু এই সমস্ত কাজ করার জন্য কখনও বাধার সম্মুখীন হননি? সোনাল রোচানি জানান, ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল, এই ৮ বছরের জার্নিতে কম হয়রানি, বাধার সম্মুখীন হননি তিনি। আদিবাসী মহিলাদের আস্থা অর্জন, তাঁদের স্বামীদের বা আদিবাসী সমাজের রাগ, সন্দেহ পেরিয়ে এখন নিজেদের লক্ষ্যপূরণে অনেকটাই সফল হয়েছে তাঁর সংস্থা।

Comments are closed.