কাশ্মীরি হওয়ার অপরাধে গ্রেফতার ৩ তরুণের নির্দোষ প্রমাণে ২৩ বছর! কাশ্মীরে নিজের ঘরে ফিরলেন এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়ে
শ্রীনগর ডাউন টাউনের আধ ভাঙা বাড়িতে তখন তিল ধারণের জায়গায় নেই। প্রায় আড়াই দশক পর ঘরে ফিরেছে ছেলে। পাড়া, প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনরা তাই দেখা করতে এসেছেন লতিফ আহমেদ বাজার সঙ্গে। লতিফের অবস্থাও তখন দেখবার মতো। বাড়ি ফেরার আনন্দে আত্মহারা লতিফ খাওয়া ছেড়েছে, নাওয়া ভুলেছে। এদিকে আত্মীয় বন্ধুরা তাঁকে নিজ হাতে খাওয়াবেই। সে এক আবেগঘন আনন্দের পরিবেশ। বহু বসন্ত পেরিয়ে শ্রীনগরের আধ ভাঙা বাড়িতে যেন কলি ফিরেছে। আর ঘরের মধ্যমণি লতিফের হাসি তখন কান ছুঁই ছুঁই। কিন্তু ৪২ বছরের লতিফের ঘরে ফেরা নিয়ে এত উন্মাদনা কীসের? কারণটা খুঁজতে গেলে যেতে হবে ২৩ বছর আগে। যে সমস্ত অভিযোগে জেলে বন্দি রইলেন লতিফরা, ২৩ বছর বাদে আদালত জানালো, সেই অপরাধ তাঁরা করেননি।
গত ২৩ শে জুলাই রাজস্থান হাইকোর্ট বেকসুর খালাস করে লতিফ আহমেদ বাজা, মহম্মদ আলি ভাট এবং মির্জা নিসার নামে ৩ কাশ্মীরিকে। অস্ত্র পাচার এবং বিস্ফোরণের মামলায় তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। রাজস্থান হাইকোর্ট জানায়, অভিযুক্ত তিনজনের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই প্রমাণ হয়নি। তাই তাঁদের বেকসুর খালাস করার নির্দেশ।
১৯ বছরের লতিফ শাল, কার্পেটের কারবার করত। দিল্লি এবং কাঠমাণ্ডুতে কাশ্মীরি শাল এবং কার্পেটের ভালো বাজার। সেখানেই নিজের মাল সরবরাহ করত লতিফ। গোটা দেশেই এমন শালওয়ালা বিস্তর। তেমনই একদিন কাঠমাণ্ডুর ভাড়া বাড়িতে নামাজ পড়ার সময় হঠাৎই দরজায় টোকা। ২৩ বছর বাদে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত, ঝাড়া হাত-পা লতিফ এখনও সেদিনের কথা মনে করলে থমকে যান। মুক্তির আনন্দও ফিঁকে হয়ে আসে শাল ব্যবসায়ী লতিফের হাসি মুখে। দরজা খুলে দেখি খাঁকি পোষাকের পুলিশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাত পা মুখ বেঁধে দিল্লি চালান। সেদিন থেকেই জীবনটা বদলে গেলো পুরোপুরি। কান্না চেপে বলতে থাকেন লতিফ। দিল্লিতে আনার পর এক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক মারধর চলে। মারের চোটে আমার পা ভেঙে যায়, অথচ কেন মার খাচ্ছি, বুঝতে পারছি না। আসলে এটাই পুলিশের স্টাইল। আপনাকে এমন মার মারবে যে ভয়ে, ব্যথায় আপনি আধমরা হয়ে পড়বেন। তখন একটি সাদা কাগজ এনে তাতে সই করিয়ে নেবে। ব্যস, আপনার ব্যবস্থা হয়ে গেল। অভিজ্ঞতার নিরিখে বুঝেছেন লতিফ। প্রথম প্রায় ১৫ দিন কী কারণে গ্রেফতার তাই জানতে পারিনি। তারপর জানতে পারলাম ১৯৯৬ সালে মহুয়া এবং লাজপত নগর, এই দুই বিস্ফোরণে নাকি আমি অন্যতম অভিযুক্ত। বুঝতে পারছিলাম না কেউ আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে কিনা।
লতিফকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় জয়পুরের একটি জেলে। তারপর সেখান থেকে সোজা গুজরাত। সেই জেলে বছর দুয়েক থাকার পর লতিফকে আনা হয় তিহার জেলে। সেখানে কাটে ১৩ বছর। এরপর গন্তব্য জয়পুর জেল। সেখানে শেষ ৮ বছর। অঙ্কের হিসেবে ২৩ বছর।
জেলে কাটানো জীবনের বিশাল সময়কে ফিরে দেখলে কেমন লাগে? ভয়ঙ্কর, বলছেন লতিফ। ধর্মের কারণে আমরা জেলে অন্যান্য কয়েদীদের কাছে মারধর খেতাম। আমরা কাশ্মীরি শুনে, মারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। পুলওয়ামার পর তো প্রায় মেরেই ফেলেছিল মারতে মারতে। কীভাবে বাঁচলাম জানি না। বলে চলেন ২৩ বছর জেলে কাটানো, সদ্য সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়া শ্রীনগরের শালওয়ালা লতিফ। মুম্বই, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, সব জায়গা থেকে মুসলিমদের গ্রেফতার করে দেশের জেলগুলোতে ভরে রাখা হয়েছে। তাদের কারও কারও ২০-২৫ বছর হয়ে গিয়েছে জেলে। কেউ তাঁদের সুবিচার দিতে পারল না। কেউ না। আক্ষেপ ঝরে পড়ে সদ্য জেল থেকে মুক্তি পাওয়া লতিফের গলায়।
লতিফের বাড়িতে যখন খুশির জোয়ার, মির্জা নাসিরের বাড়িতে তখন অবাক করা নিস্তব্ধতা। ৩৯ বছরের মির্জা বাড়ি ফিরেছেন ঠিকই কিন্তু এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না, এই বাড়ি ছেড়েই ২৩ বছর আগে চলে গিয়েছিলেন কিনা। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। চিনতে পারছেন না ছেলেবেলার বন্ধুদেরও। অথচ মাঝ পথে খেলা ছেড়েই তো চলে যায় মির্জা নাসির। বাড়ি উপচে পড়া আত্মীয়-পড়শিদের ভিড়ের মাঝে বিড় বিড় করে মির্জা মাঝেমাঝেই বলে উঠছেন, এই তাহলে আমাদের নতুন বাড়ি! আর চোখ বেয়ে গড়িয়ে নামছে জল। ২৩ বছর বাদে ঘরে ফিরে কোনও হিসেবই যেন আর মেলাতে পারছেন না, মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিস্ফোরণের দায়ে জেলে যাওয়া নিরপরাধ মির্জা। আর জেলের অভিজ্ঞতা? লতিফ বলেনি কিছু? প্রশ্ন শুনেই জানতে চান মির্জা। আমাদের সবারই এক অভিজ্ঞতা। সেটা হল ভয়ঙ্কর। জেলে বসে ভাবতাম আর কোনওদিন কি কাশ্মীরের ওয়েদার গায়ে লাগাতে পারব? একটা আশা অন্তত পূরণ হয়েছে, কী বলেন? ২৩ বছর বাদে কাশ্মীরে ফিরে জানতে চান মির্জা নাসির।
আর এই তালিকায় তৃতীয় হলেন মহম্মদ আলি ভাট। জেলে থাকাকালীনই হারিয়েছেন মা-বাবাকে। তাই জেল থেকে বেরিয়ে শ্রীনগরের রাইনাওয়াড়ির বাড়িতে যাওয়ার আগে আলি ভাট গিয়েছিলেন মা-বাবার সমাধিস্থলে। ২৩ বছর বাদে বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে কবরে শুয়ে থাকতে দেখে নিজেকে আটকাতে পারেননি ভাট। মা-বাবার কবর জড়িয়ে ধরে তাঁর আকুল কান্নার ছবি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে দেখতে না পাওয়া আমাকে কষ্ট দেয়। নিজেকে সামলাতে পারিনি। বলছেন মহম্মদ আলি ভাট। আমরা নির্দোষ, শুধুমাত্র কাশ্মীরি হওয়ার অপরাধে আমাদের জীবন থেকে এতগুলো বছর কেড়ে নেওয়া হল। আমার পরিবারকে ২৩ বছর ধরে দেখতে পাইনি। এই শূন্যতা বলে বোঝাতে পারব না। বাকি জীবনটা ওদের সঙ্গেই কাটাতে চাই। জানালেন আলি ভাট। কিন্তু পারবেন কি? ফের চোখে শূন্যতা ধরা পড়ে ভাটের। উত্তরটা তিনিও জানেন না। ঠিক যেমন জানেন না, কী কারণে ২৩ বছর কেড়ে নেওয়া হল?
অস্ত্র পাচার সংক্রান্ত একটি মামলায় রাজস্থান হাইকোর্ট এই ৩ জনকে নিরপরাধ আখ্যা দিয়েছে। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে লাজপত নগর বিস্ফোরণের সঙ্গেও এই ৩ জনের কোনও যোগ প্রমাণ করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। দিল্লি হাইকোর্ট সেই মামলাতেও এই ৩ জনকে বেকসুর খালাস করার নির্দেশ দিয়েছে।
Comments are closed.