‘মানি-মাসল-মিডিয়া’, ত্রিমূখী কৌশলে চিন দমন করতে চাইছে হংকংয়ের আন্দোলন, কী পরিস্থিতি এশিয়ার বাণিজ্য রাজধানীর
গণতন্ত্রের দাবিতে পথে নেমেছে হংকং। হাজার-হাজার মানুষ পুলিশ এবং চিনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কাঁদানে গ্যাস কিংবা হাই ডেফিনেশন ক্যামেরা, কোনও কায়দাতেই বাগে আনা যায়নি আন্দোলনকারীদের, বরং প্রতিদিনই নিয়ম করে বাড়ছে আন্দোলনকারীর সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে হংকংয়ের আন্দোলন মোকাবিলায় মানি-মাসল-মিডিয়া, এই ত্রিফলা কৌশল নিতে চলেছে কমিউনিস্ট চিন।
মানি
এশিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী বলে পরিচিত হংকংয়ে যেমন আন্দোলনকে সমর্থন জানানো বাণিজ্যিক সংস্থা রয়েছে, ঠিক তেমনই রয়েছে চিনপন্থী সংস্থাও। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, এই আঁচ করে শি জিন পিং প্রশাসন এবার চিনপন্থী সংস্থাগুলোকে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আন্দোলন ভাঙতে মাঠে নামিয়েছে। পাশাপাশি, আন্দোলনের সমর্থনকারী সংস্থা কিংবা সংস্থার কর্মীদের উদ্দেশে লাল চিন জারি করছে একের পর এক নির্দেশিকা, যাতে হুমকির ছায়া দেখতে পাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। হংকংয়ের বিমান সংস্থা ক্যাথে প্যাসিফিকের সিংহভাগ কর্মী আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এই খবর পেতেই চিন তাদের মূল ভূখণ্ডে ক্যাথের চলাচল বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ক্যাথের যে কর্মীরা আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা রাখছেন, তাঁদের মেইন ল্যান্ড চায়নাতে ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে চিনজুড়ে শুরু হয়েছে হ্যাশট্যাগ বয়কট ক্যাথে প্যাসিফিক। জনমানসে এই বাণিজ্যিক উড়ান সংস্থা সম্পর্কে মিথ্যে তথ্য ছড়ানোর অভিযোগও রয়েছে চৈনিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ফলশ্রুতিতে শেয়ার বাজারে বিরাট ধাক্কার মুখে পড়েছে ক্যাথে। ফলে সংস্থার কর্তারা প্রচণ্ড চাপে। এক সপ্তাহ ধরে চাপানউতোর চলার পর শুক্রবার ইস্তফা দিয়েছে ক্যাথের সিইও।
মাসল
হংকং সংলগ্ন চিনের মূল ভূখণ্ডে অপেক্ষা করছে রেড আর্মির অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক। বেজিংয়ের একটি সবুজ সঙ্কেতের কেবল অপেক্ষা। পাশাপাশি, চিনপন্থী ব্যবসায়ী এবং হংকংয়ের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে খোলা চিঠি লেখানো হয়েছে। আন্দোলন ভালো, কিন্তু তা বেপথে চলে গেলে মুশকিল, এই হল সেই চিঠির নির্যাস। অভিযোগ, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেফতারির ভয় দেখিয়ে চিন প্রশাসন সই করিয়েছে। পাশাপাশি, হংকংয়ে ব্যবসা চালানো একাধিক চিনপন্থী বাণিজ্যিক সংস্থাকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, হাজিরা খাতার প্রতি সতর্ক নজর রাখতে। কেউ অনুপস্থিত হলেই কারণ দর্শানোর নোটিস। উত্তর সন্তোষজনক না হলেই, চাকরি নট। তবে এভাবেও দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না হংকংবাসীকে। চাকরির পরোয়া না করে চিনপন্থী সংস্থা থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়েছেন অন্তত দু’হাজার মানুষ। তাঁদের সাহায্যে আবার এগিয়ে এসেছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া স্থানীয় কর্পোরেট। ফলে চিনের এই নীতি কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু চিনের সবচেয়ে মুশকিল হয়েছে হংকংয়ের কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোকে নিয়ে। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রী পড়তে আসেন। ফলে সেখানে চিনের সরাসরি হস্তক্ষেপ কিংবা চাপের নীতি একেবারেই কাজ করছে না। আন্দোলনকারীদের দাবি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা বিনা শর্তে তাদের সমর্থন করছেন এবং চিনের প্রকাশ্য বিরোধিতায় সামিল হচ্ছেন।
মিডিয়া
হ্যাশট্যাগ ক্যাথে এই চিনে ট্রেন্ডিং লিস্টে একেবারে উপরের দিকে। তবে এখানেই শেষ নয়, চিনের মূল ভূখণ্ড থেকে লাগাতার হংকং আন্দোলনবিরোধী প্রচার চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যার অধিকাংশ অ্যাকাউন্টই ফেক। ফেসবুক একদিনে ১ হাজারেরও বেশি এমন ফেক অ্যাকাউন্ট ডিলিট করেছে। ট্যুইটার আন্দোলনপর্ব চলাকালীন গত দু’ তিন মাস ধরে ২ লক্ষেরও বেশি হ্যান্ডেল সাসপেন্ড করেছে। যেগুলি চিনপন্থী তত্ত্ব ছড়ানোর কাজ করছিল বলে ট্যুইটার সূত্রে খবর। তারা জানিয়েছে, সবকটি হ্যান্ডেলই চিনের মূল ভূখণ্ড থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠছে, যে মূল চিন ভূখণ্ডে ফেসবুক, ট্যুইটার নিষিদ্ধ, সেখানে কীভাবে রাতারাতি এত ফেক হ্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে? সবচেয়ে বড় কথা, টেলিগ্রাম বলে যে অ্যাপের মাধ্যমে শুরুতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছিলেন আন্দোলনকারীরা, সেই অ্যাপের মালিক রাশিয়া থেকে জানিয়েছেন, মূল চিন ভূখণ্ড থেকে তাঁদের সার্ভার হ্যাক করা হয়েছে। তারপর থেকে সতর্ক হয়ে যান আন্দোলনকারীরা। নিজেরাই তৈরি করে ফেলেন একটি কমিউনিকেশন অ্যাপ। কিন্তু যেভাবে চিনের মূল ভূখণ্ড থেকে একের পর এক সোশ্যাল সাইটের সার্ভার হ্যাকের খবর রোজ আসছে, তাতে চিন প্রশাসনের হাত আছে বলেই অভিযোগ করছেন আন্দোলনকারীরা।
Comments are closed.