যাঁরা ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করেন এবং খুঁজে থাকেন “What is Bitcoin”, তাঁরা এতদিনে বিটকয়েনের সঙ্গে পরিচিত। বাকিরা বিটকয়েনের নাম শুনলেও এটা কী ও কেন, কী কাজে লাগে তা জানেন না। আসুন জেনে নিই বিটকয়েন কী, এর ব্যবহার, উৎপত্তির ইতিহাস ইত্যাদি।
বিটকয়েন কী ? (What Is Bitcoin ?)
বিটকয়েন হল এমন একটি মুদ্রা যা কাগজে ছাপা হয় না। সোনা, রুপো, তামার কয়েনেও নয়। বিটকয়েন হল একটি ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি যা দিয়ে শুধু নেট জগতেই লেনদেন চলে। ইন্টারনেটে কেনাবেচার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব।
এটি একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা, যার কোনও নিয়ন্ত্রণকারী দেশ নেই, সংস্থা নেই, ব্যাঙ্ক নেই। ফলতঃ জানার উপায় নেই বাজারে কত বিটকয়েন আছে বা এর জালিয়াতি হচ্ছে কি না।
সূত্রপাত
বলা চলে, ২০০৮ সাল নাগাদ বিটকয়েন নেটদুনিয়ার কেনাবেচার মাধ্যম হয়ে ওঠে।সাতোশি নাকামাতো নামে কোনও এক ব্যক্তি বা সংস্থা বিটকয়েনের স্রষ্টা বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামে ২০০৮ সালের অক্টোবার মাসে ৯ পৃষ্ঠার “Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System” শীর্ষক একটি গবেষণা প্রস্তাবনা অনলাইনে প্রকাশ করা হয়, যেখানে প্রথম বিটকয়েন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। যার সারসংক্ষেপে বলা হয়, এটি একটি পিয়ার-টু-পিয়ার ইলেক্ট্রনিক মুদ্রা পরিশোধের ব্যবস্থা, যেটির মাধ্যমে একজন অন্যজনের সঙ্গে কোনও তৃতীয় পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে না গিয়েই লেনদেন সম্পন্ন করতে পারবে। সেই সঙ্গে ‘ডাবল স্পেন্ডিং’ থেকে বিরত থাকতে পারবে। এই ব্যবস্থায় সব ধরনের লেনদেন সম্পন্ন হবে আস্থার ভিত্তিতে নয়, ‘কাজের (লেনদেন) প্রমাণের’ ভিত্তিতে এবং সব ধরনের লেনদেন একটি নিদিষ্ট নেটওয়ার্কে লিপিবদ্ধ হবে।
প্রস্তাবনা প্রকাশের পর থেকে সাতোশি বিটকয়েন ‘মাইনিং’ এর জন্য প্রথম সফটওয়্যার তৈরি করে। ‘মাইনিং’ হচ্ছে বিটকয়েন তৈরি করার পদ্ধতি। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সাতোশি প্রথম বিটকয়েন মুদ্রা রিলিজ করে। এই সাতোশি নাকামোতোর আসল পরিচয় এখনও অজানা।
ব্যবহার ও মূল্য
প্রতি ঘণ্টায় বিটকয়েনের মূল্য পরিবর্তিত হয়। ভারতীয় মুদ্রার নিরিখে কখনও এক বিটকয়েন ৮ লক্ষ টাকার সমান হতে পারে, কখনও তার চাইতেও বেশি।
সম্পূর্ণ ডিজিটাল উপায়ে তৈরি এই মুদ্রার বাস্তবে কোনও ফিজিক্যাল অস্তিত্ব নেই। কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এটি নিয়ন্ত্রণ করে না। ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী এটি ব্যবহারের ফলে এর মুদ্রা ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। পিয়ার-টু-পিয়ার ব্যবস্থার কারণে কোনও প্রতিষ্ঠান বা মিডলম্যান ছাড়াই সরাসরি লেনদেন সম্পন্ন হয়। ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহৃত হওয়ার কারণে উপযুক্ত অনুমতি ছাড়া বিটকয়েনের অ্যাকসেস নেওয়া অসম্ভব। আর একটা ব্যাপার হল বিটকয়েনে সম্পূর্ণভাবে ছদ্মনামে লেনদেন সম্ভব।
যত সময় যাবে বিটকয়েনের মূল্য তত বাড়বে বলে ধারনা।
কীভাবে কাজ করে
পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক হওয়ার কারণে বিটকয়েনের ট্র্যানজাকশন বা লেনদেন দাতা ও গ্রহীতার ‘ওয়ালেট’ থেকে ‘ওয়ালেটে’ সম্পন্ন হয়। ‘ওয়ালেটে’ বিটকয়েন সঞ্চিত থাকে। এটি অনলাইন বা অফলাইন দু’রকমেই হতে পারে। একজন বিটকয়েন ব্যবহারকারীকে দুটি ‘কি’ (Keys) ব্যবহার করতে হয়। একটি ‘পাবলিক কি’ (Public Key), এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। অন্যটি ‘প্রাইভেট কি’ (Private key), এটি গোপন থাকে এবং লেনদেনের নিশ্চয়তার জন্য ব্যবহৃত হয়।
ট্র্যানজাকশনের ইতিহাস একটি খতিয়ানে (পাবলিক লেজার) রেকর্ড করা থাকে, যাকে ‘ব্লক চেন’ (Block chain) বলে। এ ক্ষেত্রে ‘পাবলিক কি’ ব্যবহার করা হয় এবং একই লেনদেন একই ব্যবহারকারীর মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি করা যায় না। ব্লকচেনে সর্বপ্রথম ট্র্যানজাকশনের হিসাব থেকে আজ পর্যন্ত সব হিসাব সংরক্ষিত আছে এবং নিয়মিতভাবে আপডেট হচ্ছে।
বিটকয়েনের বহুল প্রচলনের কারণ
সেট আপ সহজেই
সাধারণ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তুলনায় বিটকয়েন অ্যাকাউন্ট সেট আপ করা ভীষণ সহজ। ন্যূনতম কম্পিউটার জ্ঞান আর অনলাইনে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলে খুব সহজেই বিটকয়েন অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। এই অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য কোনো ফি লাগে না।
গোপনীয়তা
একজন ব্যবহারকারী একাধিক বিটকয়েন অ্যাড্রেস ধারণ করতে পারেন যেখানে তার কোনও নির্দিষ্ট নাম, ঠিকানা কিংবা অন্য ব্যক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয় না। সাধারণত প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এই ধরনের গোপনীয়তা ডিজিট্যাল মুদ্রার সিস্টেমে দেখা যায় না। এই কারণে নেটিজেন থেকে ব্যবসায়ী, সবাই বিটকয়েন ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ।
স্বচ্ছতা
বিটকয়েন নেটওয়ার্কে লেনদেনের বিস্তারিত বিবরণ একটি বিরাট অথচ সাধারণ খতিয়ানের মাধ্যমে সংরক্ষিত রাখা হয়, যার নাম ব্লকচেন। তাই বিটকয়েন ব্যবহারকারীকে তার লেনদেনের যাবতীয় তথ্য আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে হয় না। বিটকয়েন সিস্টেমে চাইলেই একজন ব্যবহারকারী তাঁর লেনদেনের গতিবিধি দেখতে পারেন, সুতরাং এখানে কোনও জালিয়াতির সম্ভাবনা প্রায় নেই।
স্পিড
বিটকয়েন সিস্টেম চকিতে কাজ করে। অর্থ স্থানান্তর করার কয়েক মিনিটের মধ্যে তা পৌঁছে যাবে অন্য প্রান্তের সার্ভারে। বিটকয়েন নেটওয়ার্ক পেমেন্ট প্রসেসও খুব দ্রুত সম্পন্ন করে। এই কারণে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিষ্ঠানিক লেনদেনের জন্যও আজকাল বিটকয়েন ব্যবহার করতে বেশি আগ্রহী।
অন্যান্য সুবিধা মুদ্রার মান ক্রমাগত অবনমনের জন্য অর্থনীতিতে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যার ফলে সাধারণ মানুষকে বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাই মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধের জন্য অনেকেই বিটকয়েনকে একটি প্রতিকার হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ মুদ্রার উপর চাপ কমাতে ডিজিট্যাল মুদ্রার ব্যবহার বাড়ানো উচিত। বিটকয়েন যেহেতু প্রথম ডিজিট্যাল মুদ্রা, তাই এর ব্যবহার মানুষ বেশি করছে।
বিটকয়েনের অসুবিধা
১) এর অন্যতম অসুবিধা হল, কোনও কারণে লেনদেন যদি অসম্পূর্ণ হয়ে যায়, গ্রহীতা সেই সেবা না পেলেও মুদ্রা ফেরত পাওয়ার কোনও উপায় নেই।
২) বিটকয়েন ‘ওয়ালেট’ হারিয়ে গেলে বা নষ্ট (ড্যামেজ) হয়ে গেলে এটি আর ফিরে পাওয়া যাবে না। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বিটকয়েন একেবারেই স্থিতিশীল নয়।
৩) এর ব্যবহার ক্রমে বাড়ছে, কিন্ত তা প্রচলিত মুদ্রার তুলনায় খুবই সীমিত পরিসরে। তাই একে প্রচলিত মুদ্রায় পরিবর্তন করে ব্যবহার করতে হয়।
৪) বিটকয়েনে কোনও ক্রেডিট ব্যবস্থা নেই। এটি একটি ভালো দিকও বটে, কিন্ত বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি চলছে ক্রেডিট নির্ভর ব্যবস্থায়। ক্রেডিটের উপর ভিত্তি করে আমরা বিভিন্ন পণ্য সেবা নিয়ে থাকি।
বিটকয়েনের প্রতিদ্বন্দ্বী
বর্তমানে প্রায় ৫০০ ক্রিপ্টোকারেন্সি বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এর মধ্যে লিটকয়েন এবং রিপল বেশ জনপ্রিয়।
বিটকয়েন লেনদেনের ইতিহাস
বিটকয়েনের বিনিময়ে প্রথম পণ্য কেনা হয় ২০১০ সালের ২১ মে। বিটকয়েন ব্যবহারকারী লাসজলো (Laszlo) ১০ হাজার বিটকয়েন মুদ্রার বিনিময়ে ২৫ ডলার মুল্যের একটি পিৎজা কেনেন।
কারা ব্যবহার করেন বিটকয়েন
বিশ্বব্যাপী ৩০ হাজারের বেশি ব্যবসায়ী এবং প্রতিষ্ঠান বিটকয়েন গ্রহণ করে। মার্কিন শেয়ারবাজার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নাসদাকের তথ্য বলছে, অনলাইন খুচরা বিক্রেতা Overstock.com, ব্রিটেনে রিচার্ড ব্রায়ানসন পরিচালিত বিমান সেবা প্রতিষ্ঠান Virgin Galactic, জনপ্রিয় ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম WordPress, মার্কিন গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান Tesla Motors ছাড়াও অনলাইন ডেটিং ওয়েবসাইট থেকে এবং টরেন্ট সাইট The Pirate Bay বিটকয়েনের মাধ্যমেই পরিষেবা আদান-প্রদান করে থাকে।
Comments are closed.