দৃষ্টান্ত: অধস্তন কর্মীকে ছাঁটাই না করে নিজেই ইস্তফা দিলেন সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের বিভাগীয় প্রধান প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়
করোনাভাইরাস ও লকডাউনের মধ্যে বেনজিরভাবে কর্মী ছাঁটাই করছে কলকাতা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব বড় সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী। মালিক বা ম্যানেজমেন্টেরর নির্দেশে বিভাগীয় প্রধান বা সম্পাদকরা যখন নির্দ্বিধায় অধস্তন কর্মীদের ছেঁটে ফেলছেন, তখন এক দৃষ্টান্তমূল এবং ব্যতিক্রমী অবস্থান নিলেন এক সর্বভারতীয় সংবাদপত্রের কলকাতায় কর্মরত এক বিভাগীয় প্রধান। তিনি প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ম্যানেজমেন্টের কথায় অধস্তন কর্মীকে না ছেঁটে নিজেই চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন।
সর্বভারতীয় এক প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের ক্রীড়া বিভাগের প্রধান প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাঁর পাঁচজনের টিমের সবচেয়ে ‘দুর্বল’ পারফর্মারকে চিহ্নিত করতে। লক্ষ্য সেই একই, ছাঁটাই। কিন্তু ব্যতিক্রমী এই ডেপুটি নিউজ এডিটর সহকর্মীদের উপর ছাঁটাইয়ের খাঁড়া না নামিয়ে নিজেই ইস্তফা দিয়েছেন। এখন এক সহকর্মী বসেছেন তাঁর ছেড়ে আসা পদে।
অতিমারির সময়ে সবাই যখন নিজের চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন কীভাবে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি? প্রতীকবাবুর কথায়, দীর্ঘ আট বছর আমার সঙ্গে কাজ করছেন সহকর্মীরা। সবার পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা জানতাম। এই দুঃসময়ে চাকরি গেলে তাঁরা কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন তা জানতাম। এঁদের মধ্যে আমার নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা কিঞ্চিত ভালো। তাই স্ত্রীয়ের সঙ্গে আলোচনা করে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছি। আর কোম্পানির উদ্দেশ্যমতো ওই বিভাগে একজন কর্মীও কমানো গিয়েছে!
প্রতীকবাবুর কথায়, এপ্রিল মাসে অফিসের সবাইকেই কর্তৃপক্ষের তরফে মেইল করে জানানো হয়, তাঁদের বেতন কাটা হচ্ছে। এই বেতন কাটার হিসেব কিছুটা জটিল। তাঁর অধস্তন কর্মীদের ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা বেতন কাটা হয়েছে। তবে জানানো হয় ওই কেটে নেওয়া অর্থর একটা অংশ পরে সংস্থা সুবিধা অনুযায়ী ফেরত দেবে। কিন্তু প্রতীকবাবুর মতো পদস্থ কর্মচারীর বেতন কাটাই হয়। এপ্রিল মাসে ১৪ হাজার টাকা বেতন কাটা হয়েছে তাঁর। প্রতীকবাবু জানান, এর মধ্যেই অফিসে কানাঘুষো শুনতে থাকেন, পরের পদক্ষেপ কর্মী ছাঁটাই। খবরও আসতে থাকে আজ অমুকের চাকরি গেল, কাল আর একজনের। এই পরিস্থিতি এলে তিনি কী করবেন, তা আগেই ভেবে রেখেছিলেন সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের ডেপুটি নিউজ এডিটর (ডিজিটাল কনটেন্ট) প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সংবাদমাধ্যমের দিল্লির সিনিয়র এডিটরের ফোন পান। তাঁকে বলা হয়, দলের ‘ওয়ার্স্ট পারফর্মার’কে চিহ্নিত করতে। প্রতিক্রিয়ায় সেই সিনিয়র এডিটরকে প্রতীকবাবু জানান, তাঁর ছোট দলের সবাই ভালো কাজ করেন। এর মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া খুব কঠিন। প্রতীকবাবু জানতেন, তাঁর বেছে দেওয়া নামটির আরও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কাটা হতে পারে অথবা সরাসরি ছাঁটাই। তাই নিজেই ইস্তফা দেবেন বলে জানিয়ে দেন তিনি। একথা শুনে হকচকিয়ে যান দিল্লির সেই সিনিয়র এডিটর। প্রতীকবাবুকে বোঝান, তিনি সংস্থার অন্যতম সদস্য। যদিও প্রতীকবাবু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় দিল্লির এডিটর তাঁকে রিজিওনাল এডিটরের সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন। বলা হয়, আলোচনা করে দেখো, যদি সবার চাকরিই বাঁচানো যায়।
আরও জানতে ক্লিক করুন: সত্যিই কি মিডিয়া সংকটে নাকি পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে মালিকপক্ষ?
কলকাতায় অফিস হলেও প্রতীকবাবু পাটনা, রাঁচি, ভুবনেশ্বর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এডিশনের দায়িত্বে ছিলেন।
করোনা পরিস্থিতির আগে চারপাতা বা তিনপাতা জুড়ে যে খেলার খবর থাকত দৈনিক পত্রিকায়, সেটা একপাতায় এসে ঠেকে। পরে সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপন বাদে মাত্র ৩০ সেন্টিমিটার জায়গা দেওয়া হয় খেলার খবরগুলিকে। প্রতীকবাবু ইঙ্গিতটা বুঝেছিলেন। প্রতীকবাবুর কথায়, ফোনে যখন রিজিওনাল এডিটরের সঙ্গে এই ছাঁটাইয়ের বিষয়ে কথা বলেন, তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন। তবে তখনই কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বারণ করেন তিনি। উদ্বেগের মধ্যে তিনি টেক্সট মেসেজ করে রিজিওনাল হেডকে জানান, আর অপেক্ষা করা যাবে না, তিনি পরিস্থিতি বুঝে ইস্তফাই দিচ্ছেন। ওই সময় হুগলির তেলিনিপাড়ায় গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনায় জেলাজুড়ে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল। কোন্নগরের বাসিন্দা প্রতীকবাবু ইন্টারনেট সংযোগ আসার পর ১৬ মে তিনি সংস্থার এমপ্লয়ি পোর্টালে গিয়ে পদত্যাগ করেন। যদিও সেদিনই সেই এডিটর প্রতীকবাবুকে জানান, তিনি এখনই ইস্তফা গ্রহণ করছেন না। যেহেতু তিনি এমন একটা বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাই সংস্থার তরফে যাতে একটা ভালো আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া হয় সেটা নিয়ে আলোচনা করবেন। প্রতীকবাবুর কথায়, এভাবে উদ্বেগের মধ্যে থাকা যাচ্ছিল না। কারণ, ইস্তফা গৃহিত না হলে তিনি নিজের জন্য পরের সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। কয়েক দিন পরে ওই এডিটর ফোন করে জানান, কেন নিজে থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন প্রতীকবাবু। এডিটরের পরামর্শ, কোম্পানি ছাঁটাই করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন প্রতীক। তাতে আরও ভালো আর্থিক প্যাকেজ পেতে পারেন। এবার মেজাজ হারান প্রতীক। তিনি জানান, সম্মানের সঙ্গে কাজ ছাড়তে চান, কেন তিনি ছাঁটাইয়ের জন্য অপেক্ষা করবেন? প্রতীকের কথায়, এটা শুনে এডিটর ক্ষুব্ধ হন। হুমকির সুরে তাঁকে শোনানো হয়, বড়লোকদের টাকার প্রয়োজন হয় না। এও বলা হয়, চাকরি ছেড়ে সবার কাছে ‘হিরো’ হওয়ার চেষ্টা করছেন প্রতীকবাবু। কিন্তু চেষ্টা করেও এত বড় সংস্থার উপর একটি আঁচড়ও কাটতে পারবেন না তিনি। প্রতীকবাবুর সপাট উত্তর ছিল, হিরো হওয়ার কোনও বাসনা নেই। তবে হিরোর মতো সত্যিই যদি কাজ করে থাকেন, সেটা আটকাতেও কেউ পারবেন না। এর দু’দিনের মধ্যে অবশেষে প্রতীকবাবুর পদত্যাগ পত্র গৃহিত হয়। তাঁর পদত্যাগের পর আরও এক দফা স্যালারি কাট হয়েছে ওই সংস্থায়।
২০০৫ সালে ট্রেনি সাংবাদিক হিসেবে দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় যোগ দেন প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখান থেকে হায়দরাবাদে ডেকান ক্রনিকেলের ক্রীড়া বিভাগের সম্পাদকের কাজ নেন ২০০৭ সালে। তবে ৭০ হাজার টাকা বেতনের সেই চাকরি ছেড়ে কয়েক মাসের মধ্যে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় কাজ নিয়ে। এরপর সারদা গ্রুপের ইংরেজি পত্রিকা বেঙ্গল পোস্টের চিফ সাব এডিটর হিসেবে কাজ নিলেও, সংস্থার ভিতর ‘গণ্ডগোলের’ আঁচ পেয়ে সেই চাকরি ছেড়ে দেন প্রতীক। এরপর ২০১২ সাল থেকে এক সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের ডেপুটি এডিটরের পদে কাজ করছিলেন তিনি।
বেলুড়ের রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দির থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক হওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস কমিউনিকেশনে এমএ পাশ করেন প্রতীক। এমএ পাশ করার আগেই চাকরি জীবন শুরু হয় তাঁর। ১৫ বছরের সাংবাদিক জীবন নিয়ে কোনও খেদ নেই। সাংবাদিক জীবনের ‘গ্ল্যামার’ তাঁকে আবিষ্ট করতে পারেনি। তাই সম্মানের সঙ্গে কাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এই ক্রীড়া সাংবাদিক। এবার কী করবেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি একটু না ভেবে বলে দিতে পারেন, কিছু না করলে ছেলে-মেয়েদের পড়াব। নিজের ব্লগ ও লেখালেখির জগতে আরও বেশি করে সময় দিচ্ছেন এখন। সেই বিকেল চারটে থেকে রাত সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত খবর কাগজের অফিসের চাপ হয়ত মিস করছেন। তবে তা নিয়ে আর মন খারাপ বা চিন্তা নেই তাঁর। প্রতীকবাবু বলেন, একজন পুরুষ চাকরি ছাড়লে সবাই হয়ত বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করেন এবার কী করবেন? কিন্তু আমার জায়গায় আজ যদি স্ত্রী চাকরি ছাড়তেন তাহলে এই প্রশ্ন উঠত না। প্রতীকবাবুর স্ত্রী ডোমজুড়ের একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে পড়ান। মা পেনশন পান, সম্প্রতি বোনের বিয়ে হয়েছে, তিনিও চাকরি করেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা করেন প্রতীক। এবারের বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘কবির ভয়ের ভেতর’। ২০১৪ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইয়ের নাম ‘খাতা ছেঁড়া নৌকো’। কিছুদিনের মধ্যে একটা উপন্যাস প্রকাশ করবেন নিজের ব্লগে। সেখানে দেওয়া থাকবে পেমেন্ট অপশন। কেউ চাইলে তাতে টাকা দিতে পারেন। তবে না দিলেও উপন্যাস পড়ে নিতে পারবেন, জানান প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়।
(সাংবাদিক প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদনে যে সংস্থায় তিনি কর্মরত ছিলেন তার নাম প্রকাশ করা হয়নি প্রতিবেদনে। তাছাড়া এডিটরদের সঙ্গে তাঁর মৌখিক কথোপকথন হওয়ায়, তাঁদের নামও অপ্রকাশিত রাখা হয়েছে।)
Comments are closed.