‘বুদ্ধ, you are wrong. sushanta is right’, মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বললেন জ্যোতি বসু।
আগেই লিখেছি, গড়বেতায় বিরোধীরা প্রথমে আঘাত হানে এবং সেখানে প্রতিরোধ সংগ্রামে যুক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছিল। সেখানে যাতে এই সন্ত্রাস পুরোপুরি বন্ধ হয়, তা কার্যকর করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এই সিদ্ধান্ত নিতে দলের ভিতরেও অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। জ্যোতি বসুকেও জানিয়ে দিয়েছিলাম, তিনি বিদেশ থেকে ফেরার পর তাঁকে ভালো খবর দিতে পারব।
২০০০ সালের ২৫ জুন, যেদিন কলকাতা পুরসভার নির্বাচন, সেদিনই একসঙ্গে মেদিনীপুর জেলার সীমানাবর্তী সব গ্রামে পার্টির পতাকা তোলা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। যে বাধাই আসুক, তা অতিক্রম করা হবে, গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। দুপুরের মধ্যেই গ্রামের আবাল বৃদ্ধ-বনিতা বাইরে বেরিয়ে পার্টির পতাকা তোলার ব্যবস্থা করেন। কোনও বাধাই সেদিন তাঁদের আটকাতে পারেনি। গ্রামগুলোতে কোনও ঘটনা না ঘটলেও, গড়বেতা শহরের পার্টি অফিস ভাঙচুর করে সেদিন জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এছাড়া আর কোনও ঘটনা সেদিন গড়বেতার মাটিতে ঘটেনি। গড়বেতার এই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের সাফল্য পার্শ্ববর্তী বহু এলাকার মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁরাও দ্রুত সংঠিত হওয়ার চেষ্টা করেন।
এরপর, গড়বেতার চমকাইতলায় পার্টির যুবদের ডাকা এক সমাবেশ থেকেই (১১ অগাস্ট, ২০০০) মানুষকে নিয়ে পার্টির এই প্রতিরোধ বার্তা গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই সমাবেশের গুরুত্ব সে সময় অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল, যেহেতু তার দুদিন আগেই, ৯ অগাস্ট ‘চমকাইতলা চলো’ বলে তৃণমূলের তরফ থেকে ওই এলাকায় একটি সভা করা হয়েছিল। তাই বাম যুবদের ডাকা সমাবেশ অন্য মাত্রা পায়। বহু মানুষ উদ্দীপনা নিয়ে এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। সেই যুবদের ডাকা সমাবেশে এত মানুষ এসেছিলেন যে, তাঁদের সকলকে জায়গা দেওয়া এলাকার কোনও একটি নির্দিষ্ট মাঠে সম্ভব ছিল না। বৃষ্টির জন্য প্রথমে সভা বেশিক্ষণ চালানোও সম্ভব হয়নি। অঝোর বৃষ্টিতে দ্রুত সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ডেকরেটরসের লোকজনও মাইকসহ বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম খুলে নিতে শুরু করেছে ততক্ষণে। কিন্তু তখনও যত মানুষ সভা ছেড়ে যাচ্ছেন, তার থেকেও বেশি সংখ্যায় মানুষ সভায় যোগ দিতে আসছেন। সমবেত জনতার মধ্যে থেকে আওয়াজ উঠছে, ‘আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি। আবার সভা শুরু করতে হবে।’ ফলে আবার আমাকে মাইক লাগিয়ে সভা শুরু করতে হয়। এই সমাবেশে আসা মানুষের মধ্যে যে আত্মপ্রত্যয় ও মেজাজ অনুভব করেছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল সামনের লড়াইয়ে আমাদের জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
যথার্থ অর্থেই এই সমাবেশ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। সারা রাজ্যের মানুষ প্রতিরোধের এই সংগ্রামের কথা সরাসরি জানতে চাইছিল। সেই সময় জেলা কমিটির একজন সাধারণ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও রাজ্যজুড়ে পার্টির, বিশেষ করে যুবদের ডাকা সমাবেশগুলিতে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়। পার্টির তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক শ্রদ্ধেয় অনিল বিশ্বাসকে আমি বলেছিলাম, ‘আমাকে যে এই সমাবেশগুলিতে পাঠানো হচ্ছে, আমি তো জেলা কমিটির এক সাধারণ সদস্য মাত্র, রাজ্য কমিটিতেও নেই।’ শ্রদ্ধেয় অনিলদার উত্তর আমার আজও মনে পড়ে, ‘সাধারণ মানুষ চেয়েছে, যুবরা চেয়েছে, তুমি যাবে। কোন কমিটির সদস্য তা বড় কথা নয়। মানুষ গড়বেতায় প্রতিরোধ, সংগ্রামের কথা জানতে চায়।’
চমকাইতলার এই কর্মসূচির কিছুদিন পরে কলকাতার ধর্মতলায় রাজ্য যুব সংগঠনের ডাকে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে মুখ্য বক্তা ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ যুব সংগঠনের অন্য নেতারাও সেখানে নিজেদের বক্তব্য পেশ করেন। আমি কোনও নির্ধারিত বক্তা না হওয়া সত্ত্বেও, ওই সমাবেশে উপস্থিত থাকার জন্য যুব নেতারা আমাকে অনুরোধ করেন। আমি তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করার জন্য সমাবেশে উপস্থিত হই। যুব নেতারা আমাকে মঞ্চে জায়গাও করে দেন। মঞ্চে ওঠার পরই যে উন্মাদনা লক্ষ্য করেছিলাম তা সারা জীবনে ভোলার নয়। বক্তাদের ভাষণ শেষ হয়ে গেছে। সভার সভাপতি সমাবেশ শেষ হয়ে বলে ঘোষণাও করে দিয়েছেন। তাও সমানে চিৎকার চলছে। আমাকে বলতে দিতে হবে সেই অনুরোধ জানিয়ে চিৎকার শুরু করেছেন যুবরা। মঞ্চ প্রায় অবরুদ্ধ। মঞ্চে তখন কমরেড জ্যোতি বসু, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সব নেতারাই রয়েছেন। চিৎকার আর বন্ধ হয় না। তখন জ্যোতি বসু মাইক হাতে নিয়ে বললেন, ‘সভার সমাপ্তি ঘোষণা হয়ে গেছে, আজকে আর সুশান্ত বলবে না। এরপর যুবদের ডাকা সভায় ও অবশ্যই ভাষণ দেবে।’ এরপর শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসু, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য নেতারা মঞ্চ থেকে চলে গেলেন। আর আমায় আক্রান্ত হতে হলো ‘অটোগ্রাফ’ নামক ব্যধিতে। সে প্রায় মঞ্চ ভেঙে পড়ার জোগাড়। কোনও মতে যুব নেতারা ও সরকারি নিরাপত্তা রক্ষীরা সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসেন। আমি মঞ্চ থেকে সোজা শিয়ালদা স্টেশনে যাই উত্তরবঙ্গের ট্রেন ধরার জন্য। পরবর্তীকালে রাজ্যজুড়ে আমার কর্মসূচি বহুগুণে বেড়ে যায়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে একজন প্রবীণ সাংবাদিক আমাকে সতর্ক করেছিলেন। শ্রদ্ধেয় রমেন দাশ। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমার দেখা সাংবাদিকদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ধুতি পরতেন। মহাকরণে এলে উনি আমার ঘরে আসতেন। অনেক আগে রমেনবাবু প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু আমার সম্পর্কে ওনার বলা কথাগুলো, আমার জীবনে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। উনি আমায় অনেক কথা বলেছিলেন, তার সব এখানে প্রকাশ করব না। যেটুকু করলে দোষের হবে না শুধু সেটুকুই উল্লেখ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা পার্টির সাধারণ কর্মী থেকে গোটা রাজ্যের মানুষ তোমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে, জনপ্রিয়তার যে জায়গায় তুমি আজ পৌঁছেছো, তা নিঃসন্দেহে তোমাকে এগিয়ে যাওয়ার পথে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করবে। আবার তোমার এই জনপ্রিয়তার জন্য যে ব্যক্তিগত হিংসা কারও কারও মধ্যে তৈরি হবে, তাতে তোমার ক্ষতিও হতে পারে।’ বলেছিলেন, ‘আমি আর বেশি দিন বাঁচব না, এই কথাগুলো ভাই মনে রেখো।’ এর অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি প্রয়াত হন। ততদিনে কিছু কিছু ঘটনা অবশ্য আমার জীবনেও ঘটতে শুরু করে দিয়েছে। তাই বুঝতে পারছিলাম তাঁর কথার মানে।
১৯৯৯ সালের কোনও এক সময়, শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী। একদিন সকালে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট রাজ্য দফতর থেকে ফোন এল মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা রোডের পার্টির জোনাল কমিটির অফিসে। আমি তখন পার্টি অফিসের উপর তলায় একটি মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ফোন ধরেছিলেন কমরেড বিজয় রায়। আলিমুদ্দিন থেকে বলা হল, ‘জ্যোতি বসু, সুশান্ত ঘোষের সঙ্গে কথা বলবেন। তাঁকে চাইছেন।’ দিনটা ছিল রবিবার। খবর পেয়ে আমি প্রায় দৌড়ে নীচে এলাম। ফোনের ওপ্রান্তে জ্যোতি বসু। আমি বললাম, ‘আপনি খোঁজ করছিলেন আমাকে?’ উনি প্রশ্ন করলেন, আমি কোথায় আছি? বললাম, ‘চন্দ্রকোণা রোড অফিসে আছি।’ এই চন্দ্রকোণা রোড ওনার খুব পরিচিত। বামফ্রন্ট সরকার হওয়ার আগেও উনি চন্দ্রকোণা রোডে গেছেন। সরকার হওয়ার পরও অনেকবার গেছেন। বিশেষ করে ১৯৮৫ সালে যে বিধানসভা উপনির্বাচনে আমি বিধায়ক নির্বাচিত হই, তখনও তিনি সভা করতে এসেছিলেন। সেই উপনির্বাচনের সভাতেই ওনার উপস্থিতিতে প্রার্থী হিসাবে বলার সুযোগ হয়েছিল আমার। ভাষণ শেষ হওয়ার পর আমার পিঠে হাত রেখে উনি আমাকে কিছু কথাও বলেন।
যাই হোক। সেদিন ফোনে মুখ্যমন্ত্রী আমায় জানান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনও কারণে আমার উপর রেগে আছেন। আমি যেন কলকাতায় এসে একবার তাঁর (জ্যোতি বসু) সঙ্গে দেখা করি। তখন আমি পরিবহণ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁকে বললাম, ‘আগামীকাল ক্যাবিনেট মিটিং আছে। আমি আজ রাতেই কলকাতায় পৌঁছে যাব। তো কাল কখন দেখা করব?’ উনি বললেন, ‘ক্যাবিনেট মিটিং-এর পরে আমার সঙ্গে কথা বলে নেবে। আমি বলে দেব, কোন টাইমে আমার ঘরে আসতে হবে।’
এরপর আমি অনুমান করার চেষ্টা করলাম, আমার ওপর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রেগে থাকার কারণ কী হতে পারে? আমাদের জেলায় যে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিচালনাধীন জেলা পুলিশের সুপারিন্টেন্ডেন্ট প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই সংগ্রামের বিরোধিতা করে বিরোধীদেরই মদত দিচ্ছিলেন। ভাবলাম, পুলিশ সুপার হয়তো এমন কিছু রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, যেটা আমার প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রাগের কারণ হতে পারে। কেননা ইতিমধ্যেই তার কিছু নমুনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে। এসব যদিও পার্টির অভ্যন্তরের কথা। কিন্তু পার্টির মধ্যেই যখন কেন্দ্রীকতার প্রয়োগে মানুষের কাছে আমার কথা বলার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বাধ্য হয়েই যখন আমার অবস্থান সম্পর্কে মানুষকে, বিশেষ করে পার্টির কর্মী ও অনুগামী যাঁরা আমায় ভালোবাসেন, তাঁদের ওয়াকিবহাল করতে আমায় কলম ধরতে হয়েছে, তখন একথাও উল্লেখ করতে হবে।
মেদিনীপুর জেলা পুলিশের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই তৎকালীন পুলিশ তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রস্তাবক্রমে, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় কিছু বিষয়ে আলোচনা হয় (সব কথা লিখব না, তৎকালীন রাজ্য সম্পাদকও এখন প্রয়াত)। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘আমার জন্যই নাকি জেলায় সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। তাই আপাতত গড়বেতার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে গড়বেতাসহ মেদিনীপুর জেলায় যাওয়া বন্ধ করতে হবে। আমি না গেলেই জেলায় তৃণমূল-বিজেপির সন্ত্রাস আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে’। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আলোচনার পর ওই প্রস্তাব রাজ্য কমিটির সভায় অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। এই প্রস্তাবের উপর জেলাগুলির মতামত চাওয়া হয়। মেদিনীপুর-বাঁকুড়া-হুগলি এই তিন জেলার সম্পাদক এবং রাজ্য কমিটির সদস্যরা প্রত্যেকে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তিন জেলার সম্পাদক ও রাজ্য কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে পরে এও জেনেছিলাম, (এই কথা আজ তাঁরা স্বীকার করতেও পারেন, নাও পারেন) মূলত তিনটি জেলার বিরোধিতার কারণে, রাজ্য কমিটির সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়নি। যার ফলে আমার জেলায় আসার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
ফিরে আসি জ্যোতিবাবুর সেই ফোনের কথায়। জ্যোতি বসুর সঙ্গে কথা হয়ে যাওয়ার পর সেদিন রাত্রেই আমি কলকাতায় ফিরে আমার অনুমানের ভিত্তিতে একটি নোট তৈরি করি এবং ফোন করে আমার সচিবকে বলে দিই, পরদিন তিনি যেন তাড়াতাড়ি মহাকরণে চলে আসেন। তাঁকে বলি, ‘আমি একটি নোট দেব, তা বাংলায় কয়েক কপি টাইপ করে রেডি করে রাখতে হবে। আমি ক্যাবিনেট মিটিং থেকে ফিরে এসে নেব’। পরদিন (সোমবার) যথারীতি আমি পৌঁছনোর আগেই সচিব মহাকরণে চলে আসেন। আমার লেখা নোটটি তাঁকে দিয়ে, তিনি নিজে যেন কপিগুলি রেডি করেন, এই বলে আমি ক্যাবিনেট মিটিংয়ে চলে যাই। ক্যাবিনেট মিটিং শেষ হওয়ার পরই আমি জ্যোতি বসুকে বলি, ‘আপনি কাল বলেছিলেন, কখন টাইম হবে জেনে নিতে।’ তিনি বললেন, ‘মিটিং সেরে আমি নিজের ঘরেই যাচ্ছি, বিদেশি দূতাবাস থেকে একজন দেখা করতে আসছেন। তুমি সোয়া বারোটায় চলে এসো।’ তখন আমাদের ক্যাবিনেট মিটিং ৩০-৪০ মিনিটেই শেষ হয়ে যেত। তাই আমি মহাকরণে আমার ঘরে ফিরে গিয়ে সচিবের টাইপ করা কাগজটা দেখে নিলাম। ছোটখাটো কিছু ভুল ছিল, সেগুলি কলম দিয়ে ঠিক করে খামে ভরে নির্ধারিত সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে উপস্থিত হই। মুখ্যমন্ত্রীর সচিব আমাকে বলেন, ‘দূতাবাসের লোক চলে গেছে, স্যর আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনি সোজা অ্যান্টি চেম্বারে চলে যান’। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে জয়কৃষ্ণদার (জ্যোতি বসুর আপ্ত সহায়ক জয়কৃষ্ণ ঘোষ) সঙ্গে দেখা। তাঁকে বললাম, ‘আমি অ্যাণ্টি চেম্বারে কোনও দিন যাইনি।’ উনি আমাকে অ্যান্টি চেম্বারের দরজা দেখিয়ে দেন।
সেখানে ঢুকে দেখি, একটি সোফায় জ্যোতি বসু বসে আছেন। তাঁর বাঁদিকে একটি বড় সোফায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও ডান দিকের সোফায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসে আছেন। আমি ঢুকতেই জ্যোতি বসু বললেন, ‘সুশান্ত এসো বসো।’ আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে সোফায় বসেছিলেন, সেই সোফার এক ধারে বসলাম। বসার পর জ্যোতিবাবু আমায় বললেন, ‘বলো কী বলার ছিল?’ আমি বললাম, ‘আপনি আমায় আসতে বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনাকে কী বলেছেন, সে বিষয়ে কথা বলার জন্য। উনি আপনাকে কী বলেছেন, তা না জানলে আমি কী বলব?’ তখন জ্যোতিবাবু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বললেন, ‘তুমি সুশান্তর বিষয়ে যা বলেছিলে, তার জন্য আমি ওকে আসতে বলেছি। তোমার যা বলার আছে ওকেই বলো।’
যখন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলতে শুরু করলেন, তখন আমি বুঝতে পারলাম আমার অনুমানই সঠিক। দু’দিন আগে চন্দ্রকোণা রোডের দুজন জোনাল কমিটির সদস্য, একজন লোকাল কমিটির সম্পাদক আতিয়ার রহমান ও অপরজন স্বপন মন্ডলকে কেন্দ্র করে একটি ঘটনা ঘটে। এঁরা দুজন দুপুরবেলায় বাসে করে চন্দ্রকোণা রোডের পার্টি অফিসে আসার পথে, মেটাডহর জঙ্গলের একটি জায়গায় তৃণমূল দুষ্কৃতীরা জোর করে তাঁদের বাস থেকে নামিয়ে খুন করার উদ্দেশ্যে মাঠ, নদী পেরিয়ে আড়াবাড়ির জঙ্গলের দিকে রওনা হয়। এই দৃশ্য দেখতে পেয়ে মেটাডহর গ্রামের মহিলারা তাঁদের পেছন পেছন চিৎকার করে দৌঁড়তে থাকেন। তাঁরাই খবর দেন পার্টি অফিসে। খবর দেওয়া হয় পুলিশে। খবর পেয়ে পুলিশ যখন এলাকায় পৌঁছয় তখন দুষ্কৃতীরা কুবাই নদী পার করে আড়াবাড়ির জঙ্গলের কাছে পৌঁছে গেছে। যদি আর কয়েক মিনিট দেরি হত পুলিশের পৌঁছতে তবে আর এই দুই কমরেডকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হত না। অপহরণ করে তাঁদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের উপর অত্যাচারও করা হয়েছিল। এই অপহরণের খবর ততক্ষণে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় অনেক মানুষও সেখানে জমায়েত হন। অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। দু’একজন অপহরণকারীকে ধরে প্রচণ্ড মারধর করে স্থানীয় মানুষ। তার পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে পুলিশমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু এটাই ছিল। তিনি বলার সময়, তাঁর কথায় সাময়িক উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশও ঘটে। ওনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর জ্যোতি বসু আমাকে বলতে বলেন।
আমি প্রথমেই আমার তৈরি করা নোটের তিন কপি তিনজনকে পড়তে দিই। বলি, ‘আমার বক্তব্য এই নোটেই আছে, পড়ে নিন। তারপর কিছু জানার থাকলে আমি বলব।’ এই নোটের মধ্যে গড়বেতা, চন্দ্রকোণা রোড, কেশপুর এলাকার কিছু বড় ঘটনা, সন্ত্রাসের উল্লেখ, পুলিশের নির্লজ্জ ভূমিকার কথা, তখনও পর্যন্ত কত মিথ্যা মামলা আমাদের দেওয়া হয়েছে, কত ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও পোড়ানো হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত তথ্য, পাট্টার ও বর্গার জমি থেকে কতজনকে উৎখাত করা হয়েছে এবং সেই দিন পর্যন্ত আমাদের কতজন খুন ও আহত হয়েছেন তার বিবরণ ছিল। সর্বশেষে মানুষ কীভাবে সংগঠিত হয়ে পার্টির নেতৃত্বে প্রতিরোধ করতে শুরু করেছেন, তাও লেখা ছিল ওই নোটে।
এই নোট লেখার পূর্বে আমি সিপিএমের মেদিনীপুরের তখনকার জেলা সম্পাদক দীপক সরকারকে জানাই, ‘জ্যোতি বসু আমাকে ফোন করেছিলেন, কাল আমাকে ওনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। কেননা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমার বিরুদ্ধে তাঁকে কিছু বলেছেন। এই নিয়ে তিনি আলোচনা করতে চান।’ সব শুনে দীপক সরকার আমাকে বলেন, ‘তুমি কী ভেবেছ এই নিয়ে?’ তখন আমি আমার ভাবনার কথা ওনাকে বলি। এই নোটে কী কী বিষয় থাকবে তা নিয়ে ওনার সঙ্গে আলোচনা করি। উনি আমায় বলেন, ‘নোট যাতে বেশি বড় না হয় দেখো। মূল বিষয়গুলিই সংক্ষিপ্তভাবে নোটে উল্লেখ করবে।’ তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার সম্পর্কে কিছু কথাও উনি আমায় বলেন। যার ভিত্তিতে আমি সেই নোট তৈরি করেছিলাম। নোট তৈরির সময়ও একটা দ্বিধা আমার মধ্যে কাজ করছিল, একবার পুলিশের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে আমার জেলায় আসা বন্ধ হতে বসেছিল। জানি না এই নোটের পর আবার কোন সিদ্ধান্ত আমার জন্য অপেক্ষা করছে! কিন্তু আমি এক জায়গায় দৃঢ় ছিলাম, কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে মাথা নোয়াবো না।
তাঁদের ওই নোট পড়া হয়ে যাওয়ার পর আমি বলি, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার প্রেক্ষিতে আমার এই কথাই বলার ছিল। মানুষের আত্মরক্ষার তাগিদে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কি অন্যায়?’ এরপর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ইংরেজিতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বললেন, ‘you are wrong. sushanta is right. আত্মরক্ষার অধিকার সব মানুষের আছে। আমাদের পাট্টার চাষি, বর্গার চাষি উৎখাত হবে, তাঁদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হবে, আবার তাঁদেরই মিথ্যা মামলায় জড়ানো হবে, এ জিনিস চলতে পারে না। পুলিশ ঠিক করছে না। পুলিশকে ঠিক করতে হবে।’ সেদিনের সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কমরেড জ্যোতি বসু প্রয়াত হলেও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী এখনও আছেন। তাঁরা পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করা নয়। যা ঘটনা তা প্রকৃতভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরলাম। এরপর আমি জ্যোতি বসুর অনুমতি নিয়ে সেখান থেকে চলে আসি। তারিখটা আজ আর খেয়াল নেই।
এর দু-একদিনের মধ্যে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে একটি পার্টির সভায় জ্যোতি বসু উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘রাজ্যে আমাদেরই সরকার, আর গরিব মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে! পুলিশ তার ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করছে না, এ জিনিস চলতে পারে না।’ তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও যে এসব কথা তাঁকে সঠিকভাবে জানানো হয়নি, তাও তিনি উল্লেখ করেন। (চলবে)