জীবনের যাত্রা পথে ঘুরতে ঘুরতে আটের দশকে এসে পৌঁছোলাম ফরিদাবাদ শহরে। শের শাহ সুরি মার্গ, ২ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে, দিল্লি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহরটি হরিয়ানা প্রদেশে। এই শহরটি এখন একটি শিল্প নগরী।
এই নগরীর জন্ম হয়েছে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পরে, যখন পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুরা ছিন্নমূল হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে ছুটে এল। এখানে যারা এল তারা হল বানোয়াল। বানোয়ালরা আসলে পাঠান। এরা ছিল মূলত দোকানদার আর মহাজন। তাদের পুনর্বাসনের জন্য সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফুর খাঁ, যিনি জহরলাল নেহেরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ অনুরোধ করেন। তাঁরই অনুরোধে নেহেরু এই অঞ্চলটি উদ্বাস্তুদের থাকার জন্য দিলেন।
বানোয়ালরা খুব কর্মঠ এবং কষ্টসহিষ্ণু। তারা দুই বছরের মধ্যে এই জায়গাটা বাসযোগ্য করে তুলেছিল। মহিলারাও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন পাথর ভেঙে মাথায় করে রাস্তা তৈরির কাজের যোগান দিয়ে।
এই পরিকল্পনাটি রূপায়িত করার জন্য নেহেরু তাঁর এক বিশ্বস্ত বাঙালি অফিসার শ্রী ডি এন ঘোষকে ভার দিয়েছিলেন। সরকারি কর্মচারী এবং তাঁর থাকার জন্য একটি কলোনি তৈরি হলো। মিঃ ঘোষের জন্য যে বাংলোটি তৈরি হয়েছিল, পরবর্তীকালে, আমার স্বামীর থাকার জন্য ওই বাড়িটাই বরাদ্দ করা হয়।
ফরিদাবাদের পত্তন তো হল। এখন এই মানুষগুলির কর্মসংস্থান না হলেই নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে তিনটি সংস্থাকে এখানে আসার জন্য অনুরোধ করা হল। তারা হল বাটা, ইস্ট ইন্ডিয়া কটন আর হিন্দুস্থান ইলেকট্রিক। তৃতীয় সংস্থাটি কারখানাগুলির জন্য পুরুষ এবং মহিলাদের কারিগরী বিদ্যা শেখানোর ট্রেনিং সেন্টার খুলল। এই সেন্টারটি এখনও সেই রকমভাবে সংরক্ষিত রয়েছে।
পরবর্তীকালে হিন্দুস্থান ইলেকট্রিক অন্য নামে ইলেকট্রিক মোটর তৈরির কারখানা করল। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হল। আরও সংস্থা এল, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক সংস্থা ফরিদাবাদে চলে গিয়েছিল।
মজার ব্যাপার, এখানকার লোকের নথিভুক্ত বয়স ছিল সব এক। যত পারে বয়স কমিয়ে তারা চাকরিতে ঢুকেছিল। প্রত্যেকের জন্মদিন ছিল পয়লা জানুয়ারি!
এখানকার মানুষেরা সুদর্শন এবং স্বাস্থ্যবান। বাঙালিদের তুলনায় অনেক লম্বা। বেশ দশাশই। এরা প্রভু ভক্ত আর এক কথার মানুষ। মুখে যা বলে সেটা তাদের প্রতিজ্ঞা। হরিয়ানার আদি বাসিন্দারা ছাড়া এখানে থাকেন পাঞ্জাবিরা। আর ছিল কিছু বাঙালি যারা বেশিরভাগ বাটা কোম্পানি বা মাঝারি এবং ছোট-ছোট কারখানায় কাজ করত। ইস্ট ইন্ডিয়া কটনে কাপড় তৈরি হতো, তার ডিজাইন করার জন্য অনেক বাঙালি ছিল। এখানে আমিও কিছু কিছু ডিজাইন দিয়েছিলাম।
ভৌগোলিক দিক থেকে হরিয়ানা রাজস্থানের কাছে। আবহাওয়া হয় খুব গরম, নয়তো খুব শীত। বর্ষা নামমাত্র। গরমের সময় লু চলে। বা চলে ভীষণ গতির ধুলোর ঝড়। নাম আঁধি। আঁধি হলে বাড়ি-ঘর সব ধুলোয় ভরে যায়। মনে হতো যেন দশ-বিশ বছর এই বাড়িতে কেউ বাস করেনি। আঁধির পর তাপমাত্রা অনেকটা নেমে যেত।
এখানকার মাটি খুব উর্বর। ফুল, ফল, সব্জিতে খুব স্বাদ। বিশেষত শীতকালে। তখন ট্রাক ভর্তি ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি আরও কত অন্য সব্জি দিল্লির মন্ডিতে যেতে দেখেছি।
ফরিদাবাদে আছে প্রসিদ্ধ বাদখাল লেক আর সুরজ কুণ্ড। বাদখাল বেশ বড় একটা লেক। জায়গাটা ছিল খুব পরিষ্কার আর সুন্দর, অনেক পাখি আসত। নানা রঙের ফুল ফুটে থাকত লেকের চার দিকে। ওখানে হাঁটার আর বাচ্চাদের খেলার জন্য বাঁধানো জায়গা ছিল। পিকনিক করার জায়গা, রেস্তরাঁ আর টুরিস্ট লজও ছিল। লজে অনেকে গিয়ে থাকতেন।
আর সুরজ কুণ্ডের মেলা তো বিখ্যাত। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫ দিনের জন্য মেলা বসে। ভারতবর্ষের সব প্রদেশের কুটির শিল্প কর্ম এখানে আসে, খুব ভিড় হয়। এখন মেলাটা বিরাট জায়গাজুড়ে হয়। এই মেলা শুরুর সময় আমরা ফরিদাবাদে ছিলাম। তখন ছোটর মধ্যে খুব ভাল মেলা হোত। ক্ষুদ্র শিল্পের সামগ্রী, নানারকমের সাজ-পোশাক, নানান প্রদেশের খাবার জিনিস, যাত্রা আরও যে কত কী। আমি আমার প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে যেতাম। খুব আনন্দ হতো।
আমরা যখন ফরিদাবাদে গেলাম, তখন ওখানে ভাল স্কুল বিশেষ ছিল না। আমার দু’মেয়েই ভর্তি হল দিল্লি পাবলিক স্কুলে। এটি ছিল ডিপিএস-এর প্রথম স্কুল, দিল্লির-মথুরা রোডে। ওবেরয় হোটেলের উল্টো দিকে। সেই স্কুলের সুবাদে আমি রোজই দিল্লি যেতাম, মেয়েদের নিয়ে আসতে। রোজ যাতায়াতে দিল্লি-ফরিদাবাদ এক হয়ে গিয়েছিল। ফরিদাবাদে ভাল আইসক্রিম পাওয়া যেত না। অনেক দিন রাতের খাওয়ার পর আমরা, আমার বন্ধু শিবানিদের সঙ্গে ইন্ডিয়া গেটে যেতাম আইসক্রিম খেতে। শিবানির স্বামী ছিলেন বাটা কোম্পানির কর্ণধার।
১৯৮৪ সালে যেদিন ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা হল, আমি তখন মেয়েদের স্কুল থেকে আনতে দিল্লিতে গিয়েছিলাম। ওখানেই খবরটা শুনলাম। সবাই আলোচনা করছিল, এবার বর্ডার সিল করে দেবে। ফরিদাবাদ তো দিল্লি বর্ডারের ওপারে। আমরা গাড়ি ছুটিয়ে তাড়াতাড়ি বর্ডার পার করে বাড়ি ফিরে এলাম। ততক্ষণে গণ্ডগোল আরম্ভ হয়ে গেছে। এরপর শিখ নিধন শুরু হল। সবাই খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। কলোনি থেকে বেরনোই হওয়া গেল না প্রায় ১৫ দিন।
আমার মেয়েরা এবং ওখানকার এক সর্দার পরিবারের দুটি ছেলে একই স্কুলে যেত। ওদের জন্য কার পুলের ব্যবস্থা হয়েছিল। আমরা ঠিক করলাম, ওদের খোঁজ নেওয়া উচিত। আমরা গেলাম ওদের বাড়িতে। ওরা এত ভীত ছিল যে, আমাদের জন্যও দরজা খুলছিল না।
আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে কিছু পাঞ্জাবি পরিবার ছিল। তার মধ্যে একটি পরিবার আমাদের বন্ধু স্থানীয় হয়ে গিয়েছিল। মিঃ গুলাটি আর তাঁর স্ত্রী। তাঁরা বাসন্তী পূজা আর দূর্গা পূজার অষ্টমী তিথিতে আমার মেয়েদের কুমারী পুজা করতেন। তাঁদের কন্যা সন্তান ছিল না। আমার দুই মেয়েকে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওঁরা দুজন পা ধুইয়ে, মুছিয়ে, বসিয়ে পুরি, ছোলা আর হালুয়া খাওয়াতেন। তারপর নানারকম উপহার দিতেন। ওখানে পাঞ্জাবিদের মধ্যে এই রেওয়াজটা আছে। মিসেস গুলাটি রান্নার কাজে খুব পটু ছিলেন। ওনার কাছে পাঞ্জাবি রান্না শিখেছিলাম।
পাঞ্জাবিদের আর একটা উৎসব ছিল লোহরি বা লোরি। বাঙালিদের পৌষ সংক্রান্তিতে যেমন বুড়ির ঘর পোড়ানো হয়, সেই রকম ওরা পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত্রে অনেক কাঠ-কুটো জড়ো করে বিরাট আগুন জ্বালাতো। সবাই ঘুরে ঘুরে আগুনে চীনাবাদাম, তিলের রেউড়ি দেয় আর আগুনকে প্রণাম করে। আর সবাই মিলে চীনাবাদাম আর রেউড়ি খায়। উত্তর ভারতের কর্বা চৌথের কথা সবাই জানে। ওখানে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মহিলাদের এই কঠিন ব্রত পালন করতে দেখেছি।
এমনিতেও ওখানে মহিলারা গৃহকর্ম নিপুনা, পরিশ্রমী এবং সাহসী। তাঁদের দায়িত্ব মেষ পালন এবং পরিবারের জন্য দুধ, ঘি, মাখনের ব্যবস্থা করা। এরা প্রচুর পরিমাণে দুগ্ধ জাতীয় খাবার খায়। একবার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সবাই মিলে খাটিয়ায় বসেছিলাম। লণ্ঠনের আলোয় এক হাত লম্বা ঘোমটা টানা গৃহিণী মাটিতে বসে আমাদের সামনেই স্থানীয় খাবার তৈরি করছিলেন। সেই খাবার আর তাঁদের আদরে অভিভূত হয়েছিলাম।
ওখানে একজন ডাক্তারবাবু ছিলেন। ডাঃ গুপ্তা। রোজ আমার স্বামীর কারখানায় এসে ডাক্তারি করতেন, তারপর প্রয়োজন হলে আমাদের দেখতে আসতেন। উনি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ব্লাড প্রেসার দেখতে দেখতে প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তেন। পরক্ষণে জেগে উঠে নিজের ব্যাগ খুলে দু’চারটে ট্যাবলেট বার করে নিজেই খেয়ে নিতেন। আর ছিলেন চোখের ডাক্তার ছাবড়া। বিলেত ফেরত ডাক্তার। কিন্তু চোখ দেখার যন্ত্রটিতে চেক করার জন্য চোখের পাতা পুরো উল্টে দিতেন। আমার মেয়েদের খুব অপছন্দ ছিল এই চোখ ওল্টানো ব্যাপারটা। ওখানে কিন্তু লোকের ভিড় লেগেই থাকত।
আমাদের বাংলোতে খুব সুন্দর বাগান ছিল। সামনের দিকে লন আর ফুলের বাগান আর পেছনে সব্জির। ছিল আম গাছ, পেয়ারা গাছ আর বিশাল এক অশ্বত্থ গাছ। এই বাগান দেখত সোহনলাল মালি। অক্লান্ত পরিশ্রম করত আর ওর সুবাদে বাড়িটা দেখতে লাগত ছবির মত।
আমাদের বাড়ির কম্পাউন্ডের বাইরে একটা পানের দোকান ছিল। তার মালিক ছিল কিষেন লাল। ও ছিল প্রায় সাত ফুট লম্বা আর বিশাল চওড়া। লোকে ওকে ডাকত হনুমান নামে। এই কিষেন লাল গরমকালে রোজ সন্ধ্যার সময় আমাদের পুরো কম্পাউন্ডে জলের ছিটে দিত। ধুলো কম করার জন্য। মাটির সুন্দর গন্ধ পেতাম।
এখানকার বাঙালিরা অনেকেই ছিলেন কারখানার শ্রমিক। দূর্গাপুজো, কালীপুজো সবই হোত। আমার স্বামীর কারখানার অপর দিকে মিউনিসিপালিটির জমিতে হোত কালীপুজো। প্রবীণ বাঙালিরা ঠিক করলেন, ওই জমিটা জবরদখল করে ওখানেই বছর বছর সব পুজো এবং উৎসব করবেন। তাই হল। আদালতে কেস হল। কারখানার বাঙালি কর্তাদের মদতে মিটমাট হয়ে গিয়েছিল কিছু জরিমানা দিয়ে। পরে ওখানে চাঁদা তুলে দূর্গা মন্দির হয়। নাম দেওয়া হল দূর্গা বাড়ি।
এখানকার পুরনো অনেক বাঙালির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাদের নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। উদ্যোক্তাদের মধ্যমণি ছিলেন বাটা কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মিঃ দত্ত, তাঁর স্ত্রী শিবানি, আমার কর্তা আর আমি। গান, বাজনা, থিয়েটার, নৃত্য-নাট্য এই সব হোত। রিহার্সাল আমার বাড়িতে। বলাবাহুল্য সঙ্গে প্রচুর জলযোগ।
ফরিদাবাদ আর তামাম হরিয়ানার উন্নতিতে কিছু বাঙালির অবদান আছে। মিঃ ডি এন ঘোষ ছিলেন ফরিদাবাদ নগরীর পত্তনের সময়।
শ্রী বীরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী রাজ্যপাল হয়ে এলেন হরিয়ানার জন্মের প্রথম দিকে। হরিয়ানায় নদী নেই। প্রাকৃতিক জল নেই। রাজ্যপাল বীরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী পঞ্জাবের ভাকরা নাঙ্গাল প্রযুক্তি থেকে নালা কেটে জল বন্টনের ব্যবস্থা করলেন। চাষের জমি জল পেল। চক্রবর্তী মশাইকে এখানকার লোক ভগবান বলে মানে। কৃষি উৎপাদনে হরিয়ানার স্থান পঞ্জাবের পরেই।
আমরা থাকার সময় ট্যুরিজম সেক্রেটারি হয়ে এলেন ভাস্কর চ্যাটার্জি। তাঁর ওপর ভার ছিল হরিয়ানাকে পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে দেওয়ার। উনি সফল হয়েছিলেন। ভারতের সর্বসাধারণের হাওয়াই চপ্পল আবিষ্কার করেছিলেন বাটা কোম্পানির পি পি মুখার্জি। উনি আমৃত্যু ফরিদাবাদেই ছিলেন ।
আমার জীবনের যাত্রাপথ স্থগিত হলো এই ফরিদাবাদ শহরে এসে। যে ছোট্ট মেয়েটি দার্জিলিঙে বড় হয়েছিল, তার জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল মুম্বই শহরে। তারপর অনেক পথ, দেশ-বিদেশের অনেক শহর ঘুরে তা শেষে ফরিদাবাদে এসে থামল। এখন আর না থাকলেও ভালবাসার চোখে তাকিয়ে থাকি ফরিদাবাদের দিকে।
(শেষ)