জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস ফের একে অন্যের কাছাকাছি আসায় আবারও কি একবার মুখ পুড়তে চলেছে সিপিএমের? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে আপত্তি নেই, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক থেকে উঠে আসা এই বার্তা এবং তার কিছুদিনের মধ্যে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মিটিংয়ের পর বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোটপন্থী সিপিএম নেতাদের খানিকটা সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা হয়েছে। আসন্ন রাজ্য কমিটির বৈঠকে এই প্রসঙ্গ তুলে আলিমুদ্দিন নেতৃত্বকে এক হাত নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন সিপিএমের জোট বিরোধী নেতারা। আগামী ৩ এবং ৪ অগাস্ট দু’দিন ধরে দিল্লিতে চলবে সিপিএমের পলিটব্যুরোর বৈঠক। সেখানে দলের রাজনৈতিক এবং কৌশলগত লাইন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। সেখানেও এরাজ্যের জোটপন্থী নেতাদের সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে বলে সিপিএম সূত্রে খবর।
এরাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা কিংবা অলিখিত জোট নিয়ে সিপিএমের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে সেই ২০১৫ সাল থেকে। সিপিএমের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব এক সাংবাদিক বৈঠকে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার বার্তা দিয়েছিলেন। যদিও দলের এই লাইনের মূল প্রবক্তা ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। গৌতম দেবের কথায় দলের মধ্যে বিতর্ক শুরু হওয়ায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তখন নিজে আসরে নামেন। দলীয় মুখপত্র গণশক্তির ওয়েবসাইটের এই ইন্টারভিউয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানান, ‘সিপিএম এবং বামেদের একার পক্ষে তৃণমূলকে হারানো সম্ভব নয়’। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই বক্তব্যের পরই কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের রাস্তা কার্যত খুলে দেয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
২০১৬ সালের ৭ ই মার্চ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসেছিল সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠক। সেই বৈঠকে আলোচনা হয় কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে। বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া জেলা নেতৃত্ব এবং বিক্ষিপ্তভাবে আরও কিছু জেলার কয়েকজন রাজ্য কমিটির সদস্য জোটের বিরোধিতা করেন। পরিস্থিতি গোলমেলে দেখে সেদিন রাজ্য কমিটির মিটিংয়ের মাঝে মুর্শিদাবাদ জেলার কয়েকজন নেতাকে নিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেই আলাদা করে বসেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সূর্যকান্ত মিশ্র। কারণ, তাঁরা জানতেন, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস অনেক শক্তিশালী। সেই জেলায় জোট মসৃণভাবে না হলে তার প্রভাব সারা রাজ্যে পড়বে। কংগ্রেস প্রাথমিকভাবে মুর্শিদাবাদের ২২ টির মধ্যে ১৭ টি সিট চেয়েছিল। মুর্শিদাবাদের সিপিএম নেতারা তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, তৃণমূলকে হারানোর স্লোগান মুর্শিদাবাদে প্রাসঙ্গিক নয়, কারণ সেখানে তাঁদের লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে। তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁদের প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কি মনে করেন আমরা ওপর থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাদের জেলা পার্টিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছি?’ মুর্শিদাবাদের নেতারা সেদিন কোনও জবাব দেননি, বরং আলিমুদ্দিনের নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আজ প্রায় আড়াই বছর বাদে তৃণমূল কংগ্রেস এবং জাতীয় কংগ্রেসের ফের একবার কাছাকাছ আসার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা রাজ্যের জোটপন্থী সিপিএম নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। কয়েকদিন আগে ২১ শে জুলাই সমাবেশেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, রাজ্যের ৪২ টি আসনে তিনি একাই লড়বেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চলতি দিল্লি সফরে যেভাবে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী এবং নেত্রী সোনিয়া গান্ধীসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাতে রীতিমতো চিন্তায় আলিমুদ্দিন। সিপিএম নেতাদের একাংশ ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছেন, বিধানসভা ভোট নিয়ে কংগ্রেস হাইকমান্ডের কখনই বিশেষ মাথা ব্যথা থাকে না। কিন্তু লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসতেই কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা সম্ভাব্য বন্ধুর খোঁজে তৎপরতা শুরু করেছেন। সেখানে শুধুমাত্র সংখ্যার কারণেই সিপিএমের থেকে এখন অনেক এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই পরিস্থিতিতে গত আড়াই বছর ধরে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে বিধানসভার ভেতরে এবং বাইরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করার পর সিপিএমকে নতুন করে কৌশল ঠিক করতে হবে। শুধু তাই নয়, রাতারাতি কংগ্রেস তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে পড়লে সিপিএমেরও যথেষ্টই বেইজ্জতি হবে। কারণ, এতদিন কংগ্রেসের সঙ্গে থাকার ফলে এখন আর তাদের সমালোচনাও করা যাবে না তীব্রভাবে।
কৌশলগতভাবেও তৃণমূল নেত্রী চাইছেন কংগ্রেসের প্রতি একটা ইতিবাচক বার্তা দিতে। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যসভার ভোটেও তিনি কখনও কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য, কখনও বা অভিষেক মনু সিংভিকে সমর্থন করেছেন। দু’ক্ষেত্রেই কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা করে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন এমন কাউকে রাজ্যসভায় প্রার্থী করতে চেয়েছিল সিপিএম। কিন্তু দু’বারই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছেন। তারপরেও রাজ্যের সিপিএম নেতাদের একটা অংশ চাইছিলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। কিন্তু এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সোনিয়া-রাহুল ফের কাছাকাছি চলে আসায় সিপিএমের এই নেতারা বিপদে পড়ে গিয়েছেন। সূত্রের খবর, এমাসের মাঝামাঝি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে যে রাজ্য কমিটির মিটিং রয়েছে, সেখানে ফের এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার কথা। এতদিন নিজের শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা না করে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে কী লাভ হল, এখন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সিপিএম নেতৃত্বের একটা অংশ।
আগামী ৩ এবং ৪ অগাস্ট দিল্লিতে দু’দিনের পলিটব্যুরোর বৈঠক বসছে সিপিএমের। সেখানেও দলের রাজনৈতিক এবং কৌশলগত লাইন নিয়ে কথা হবে। ২০১৯ লোকসভা ভোট যত এগোচ্ছে, ততই ঐক্যবদ্ধ চেহারা নিচ্ছে বিরোধী জোট। সেখানে দাঁড়িয়ে সিপিএম ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রাক নির্বাচনী কোনও জোট নয়। পাশাপাশি আলাদা রাজ্যে আলাদা নীতি নিয়ে বিজেপির মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু এই বিজেপি মোকাবিলার পরিসরে প্রতিটি ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আগ্রাসী এবং আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিচ্ছেন, সেখানে খানিকটা ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে সিপিএম। এই বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কংগ্রেস হাইকমান্ডেরও কাছাকাছি চলে এলে সিপিএমকে নতুন করে ভাবতে হবে তাদের পরবর্তী রণকৌশল।