৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেন! এখানেই তো উত্তম কুমার আর সুচিত্রা দেবীর বিয়ের আসর বসেছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্ত্তী, জহর রায় কে না উপস্থিত ছিলেন সেই বিয়েতে? তুলসী চক্রবর্তী আবার ছিলেন কন্যা এবং বর, উভয় পক্ষের তরফেই। সাড়ে চুয়াত্তর সিনেমাটি মনে করতে পারছেন? পাঁচের দশকের সেই বিখ্যাত বাংলা সিনেমা। যেখানে আস্ত একটা মেস বাড়ির গল্প তুলে ধরা হয়েছিল, যার নাম ছিল ‘অন্নপূর্ণা বোর্ডিং হাউস’। আচ্ছা গানটি মনে করা যায়? ‘আমার এই যৌবন চম্পা, চামেলি বনে অকারণে উচ্ছল’, যা এখনও বাঙালির মনের কোণে জায়গা করে রয়েছে। কিংবা ‘বসন্ত বিলাপ’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়–অপর্ণা সেনের আসাধারণ অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। সেটার প্রেক্ষাপটেও কিন্তু মেস বাড়ি।
আসল কথা হল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে কলকাতা শহরে কাজের সূত্রে আসতে শুরু করলেন শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায়, আর প্রয়োজনের তাগিদে একের পর এক গড়ে উঠল বোর্ডিং হাউস। যেখানে ফুডিং আর লজিং এর ব্যবস্থা থাকত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোর্ডিং হাউসগুলির জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকল। আমহার্স্ট স্ট্রিট, মক্তরাম বাবু স্ট্রিট, কলুটোলা স্ট্রিট, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, এই রাস্তাগুলির উপর এক সময় একের পর এক গড়ে উঠতে শুরু করেছিল এই বোর্ডিং হাউস।
আচ্ছা বাংলা সাহিত্য? এমন অনেক নামকরা লেখক রয়েছেন, যাঁরা নিজেদের সারাটা জীবনই অতিবাহিত করেছেন এই সব বোর্ডিং হাউসে। এই যেমন শিবরাম চক্কোত্তি, মুক্তরাম বাবু স্ট্রিটের একটি মেস বাড়ির তিনতলায় থাকতেন তিনি। আর নিজের ঘরের দেওয়াল জুড়ে লিখে রেখেছিলেন দিনলিপি সমূহ। পরশুরামের ‘বিরিঞ্চি বাবা’ গল্পের সূত্রপাত ও তো সেই হাবসী বাগানের ছোট্ট ছিমছাম মেস বাড়িটি। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, মহেন্দ্রর উপর বেদম চটে তাঁর স্ত্রী আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মেস বাড়িতে।
‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’
এই দুটি লাইন বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজও ইনসুলিনের মতো কাজ করে। কিন্তু জীবানানন্দ কোথায় বসে লিখেছিলেন, জানা আছে? ৬৬ নম্বর মহাত্মা গান্ধী রোড, প্রসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস। আগে যে রাস্তার নাম ছিল হ্যারিসন স্ট্রিট। নিজের ঘরের বারান্দায় বসে ট্রাম দেখা ছিল যাঁর নেশা! আর নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, সেই ট্রামের ধাক্কায় মারা গেলেন জীবনানন্দ দাশ। ‘জীবনানন্দ যখন এই প্রসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে থাকতেন তখনও তো তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হননি। শান্ত স্বভাবের ছেলেটি বড্ড অভিমানী ছিল, এটা অবশ্য আমার দাদুর মুখে শোনা’, বললেন প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ের বর্তমান কর্ণধার সন্দীপ দত্ত। ‘দাদু চাক্ষুস দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশকে। তখনও জানতেন না যে, এই ছেলেই কিনা পরবর্তীকালে বাঙালির হৃদয় জয় করবে। দাদুর উপর মাঝে মধ্যেই অভিমান করতেন তিনি, পছন্দের ঘর না পাওয়ার জন্য। আসলে মেসের নিয়ম অনুযায়ী কেউ ঘর ছেড়ে দিলে সেই ঘর অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া হতো, কিন্তু বেশ কয়েকদিন পর ফিরে এসে জীবানানন্দের সেই ঘরই দরকার। আসলে সাহিত্যিক মানুষ তো! এই ঘর নিয়ে দাদুর প্রতি অভিমানের কথাও তিনি লিখে গেছেন নিজের ডায়েরিতে।’ জানালেন সন্দীপবাবু।
আর ছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। জানেন কি কোথায় বসে ব্যোমকেশ লিখেছিলেন শরদিন্দু? এই প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে। হ্যাঁ, এখানেই থাকতেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ‘জানেন, শরদিন্দুকে আমার বাবা কাকারা কেউ কখনও চিনতেই পারেননি। আসলে ডিটেকটিভের স্রষ্টারা কি অত সহজে ধরা দেন মশাই?’ জানালেন দত্তবাবু।
‘হাতে এক কাপ চা আর যদি সিগারেটের বদ অভ্যাস থাকে, তাহলে একটা সিগারেট জ্বালান, তারপর এই প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং-এর বারান্দায় একটা চক্কর কাটুন। আর কে জানে, শরদিন্দুও হয়তো কোনও এক সময় এই বারান্দাতেই পায়চারি করতে করতে ব্যোমকেশের কোনও এক গল্পের কথা ভেবেছিলেন!’ প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং থেকে বেরনোর সময় বললেন সন্দীপ দত্ত।
কিন্তু সে যুগ তো চলে গেছে কবেই। আজ কারা থাকেন এই মেস বাড়িগুলোতে? এই যেমন সংগ্রাম চ্যাটার্জি, শিয়ালদহ, কলেজ স্ট্রিট চত্বরের একাধিক বোর্ডিংয়ে থেকেছেন। বেঙ্গল বোর্ডিং, ক্রাউন লজ, রুবি বোর্ডিং এগুলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন সংগ্রামবাবু। আর প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং সম্পর্কে প্রশ্ন করাতে বললেন, ‘হ্যাঁ গেছিলাম, তবে রাতে থাকা হয়নি। যাওয়ার কারণ ছিল, শুধু ব্যোমকেশ আর জীবনানন্দকে একবার অনুভব করা।’ বলার সময় সংগ্রামবাবুর চোখে-মুখে যে উচ্ছ্বাস ধরা পড়ল, তাই জানান দেয়, যে কোনও বাঙালির মধ্যে ব্যোমকেশ, জীবনানন্দের প্রতি আজও অন্য একটা ফিলিংস কাজ করে।
‘কিন্তু কী জানেন, আজ সবকটা বোর্ডিং ধুঁকছে। বেঙ্গল বোর্ডিং তো ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে অ্যাংলো আরবিক স্কুল হয়েছে। আসলে এই বোর্ডিং এর বিষয়টা তো একটা কালচার। আর বেশি দিন হয়ত এই বোর্ডিং কালচারটিও থাকবে না।’ জানালেন সংগ্রামবাবু।
মজুমদারবাবুরা দু’ভাই মিলে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের রুবি বোর্ডিং চালান। বাবার পরে তাঁরাই এখন মালিক। কিন্তু তাঁদের মতে, ‘সেদিন আর এদিনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত রয়েছে। এক সময় এই বোর্ডিংগুলি গমগম করত। একটা এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলির রূপ নিত বোর্ডিংগুলি। একসাথে স্নান-খাওয়া, আড্ডা সবই চলত। কিন্তু আজ মানুষের মধ্যে সেই ব্যাপারটা চোখে পড়ে না আর।’ আরও বললেন, ‘এককালে এখানে মাত্র ৭০ টাকায় থাকা-খাওয়া সম্পূর্ণ হোত। এখন একাধিক রকমের ট্যাক্স, আগে এগুলি দিতে হোত না। যা দিন-কাল পড়েছে, তার মধ্যে এতরকম ট্যাক্স দিয়ে বোর্ডিং চালানো খুবই কষ্টসাধ্য।’ হালে এই রুবি বোর্ডিংয়ে আধুনিক বাংলা সিনেমা ‘ক্ষত’র শুটিংও হয়েছে।
বোর্ডিংয়ে থাকার এক অন্যরকম অনুভুতি রয়েছে, অকপট স্বীকারোক্তি তাপস চ্যাটার্জির। বছর ৭০ এর এই প্রৌঢ় বহু বছর ধরে বোর্ডিংয়ে রয়েছেন। বললেন, ‘মানুষের কাজের সময় বদলেছে। তখনকার দিনের মতো ১০ টা-৫ টা অফিস আর নেই। আগে যেমন অফিস থেকে মেসে ফিরে একটা আড্ডার আসর বসত, যা আজ অবলুপ্ত। আসলে মানুষের হাতে সময় কম। তবু আজও মেসের মেম্বাররা মাসের শেষের গ্র্যান্ড ফিস্টের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মাসের খরচ থেকে অল্প অল্প করে টাকা বাঁচিয়ে সেই দিন কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়া হয় আর কী!’
আসলে মানুষের মধ্যে একা থাকার প্রবণতা বেড়েছে। নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে চাইছে সকলে। আর সেখান থেকেই আসছে পেইং গেস্ট ট্র্যাডিশন। বিভিন্ন জায়গা থেকে কলকাতায় এসে পাড়ার অলিতে গলিতে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকছে প্রত্যেকে। তাছাড়া এখন মানুষের হাতে টাকাও এসেছে, তাই হয়তো নিজের মতো করে থাকতে চায়। অ্যাটাচড বাথ, এসি, টেলিভিশন আমোদ-প্রমোদের সব জিনিস নিয়ে হাজির হচ্ছেন পেইং গেস্টের মালিকরা। আর সেখানে একটু হলেও ফিকে হচ্ছে বোর্ডিংগুলো।
আগে যেমন মেস থেকে শুক্রবার সকালে একেবারে গোছগাছ করে বেড়িয়ে পড়া হোত, অফিস করে সোজা বাড়ি। আবার সোমবার বাড়ি থেকে অফিস, তারপর মেসে পৌঁছানো। এখনও শিয়ালদহ চত্বরের লজগুলিতে অনেকেই মাসের পর মাস থাকেন বটে। কিন্তু মধ্যবিত্তের মেসে থাকা অনেকটাই কমে গেছে। সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রায় পালটে গেছে মেসের চরিত্র। বহু মালিকই আর চালাতে পারছেন না তাঁদের বোর্ডিংগুলি। অনেক বোর্ডিং লাভের অভাবে ধুঁকছে। না চালাতে পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বহু বোর্ডিং। তার সঙ্গে রয়েছে প্রোমোটিং এরও হাতছানি। অনেক বোর্ডিং মালিকের পরের প্রজন্মও আর আগ্রহী নন মেস ব্যবসা নিয়ে। এটাও একটা কারণ মেসগুলোর ধুঁকতে থাকার পেছনে।
তবে কি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে কলকাতার বোর্ডিং? কিন্তু বোর্ডিং মানে তো স্রেফ থাকার একটা আস্তানা নয়। মধ্য কলকাতার মেস বাড়ি মানে তো কলকাতার এক ঐতিহ্য। ইতিহাস। বোর্ডিংগুলি তো একপ্রকার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে শহরের। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, সমরেশ মজুমদারেরা তো বহুদিন থেকেছেন কলকাতা শহরের একাধিক মেসে। বাঙালির গোয়েন্দাগিরি ও তো এই মেস জুড়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তো এক একটি মেস হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘর। আর সাতের দশক? পুলিসের ভয়ে কত অসংখ্য মানুষই না গা ঢাকা দিয়েছিল এই সব বোর্ডিংয়ে। এক একটা পুরনো মেসের ইট, কাঠ, পাথরে আজও লেখা রয়েছে কত জানা-অজানা কাহিনী।
আজ এই বোর্ডিংগুলির ভবিষৎ কী? এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। হয়তো সময়ের নিয়মে এগুলি বিলীন হয়ে যাবে একদিন। শুধু কাগজের পাতায় থেকে যাবে এক একটা বোর্ডিংয়ের ইতিহাস।
(ছবিঃ সপ্তর্ষি চৌধুরী)
Comments are closed.