রোজ মাওবাদীদের হাতে খুন হচ্ছে আমাদের লোক। একদিন বিমান বসুকে কড়াভাবেই বললাম, পুলিশ-প্রশাসন রেখে আর লাভ কী?
আগের সংখ্যাতেই লিখেছি, ২০১০ সালের শুরুতে আমাদের গোয়ালতোড় ক্যাম্পে মাওবাদীদের আক্রমণের কথা এবং পার্টি নেতা অসমসাহসী কিরীটী হাজরা কীভাবে গভীর রাতে মাত্র পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সেখানকার কমরেডদের প্রাণ রক্ষা করে। তার আগের বছরই মাওবাদীরা মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন এনায়েতপুর পার্টি অফিস আক্রমণ করেছিল। সেই রাতে তারা তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। গোয়ালতোড়েও মাওবাদীরা গভীর রাতে আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে, যদিও তাদের লক্ষ্যে সফল হতে পারেনি। কিন্তু আমাদের পার্টির ওপর অতর্কিতে আক্রমণ, কমরেডদের খুন, জখমের ঘটনা সেই সময় লেগেই ছিল। গোয়ালতোড়ে আমাদের ক্যাম্প আক্রমণের ১০-১২ দিনের মধ্যে মাওবাদীরা যে মারাত্মক কাণ্ড ঘটাল, তা আজও আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে।
২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তথা রাজ্যের ক্ষেত্রে এক ভয়ঙ্করতম ঘটনার দিন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম শহর লাগোয়া শিলদায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলের (ইএফআর) ক্যাম্প ছিল। মাওবাদীদের মোকাবিলা করার জন্য সেই সময় রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে এমন বেশ কিছু ক্যাম্প করা হয়েছিল। শিলদার সেই ইএফআর ক্যাম্পে মাওবাদীরা অতর্কিতে আক্রমণ করল। এই আক্রমণ ছিল একেবারে পরিকল্পনা মাফিক। এই আক্রমণে ক্যাম্পের সমস্ত জওয়ানকে নৃশংসভাবে খুন করে মাওবাদীরা। তারপর ক্যাম্পে মজুত সমস্ত অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র লুঠ করে নিয়ে পালায়। এর আগে রাজ্যে এতবড় মাওবাদী হামলা আর হয়নি। এর আগে এতজন জওয়ানকে খুনের ঘটনাও এরাজ্যে ঘটেনি। সেই আক্রমণের ঘটনার পর পুলিশের ভূমিকা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন তো বটেই, রাজ্য প্রশাসনের ক্ষেত্রেও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে এত অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র মজুত, এতজন ইএফআর জওয়ান কর্মরত, সেখানেই যদি এরকম ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে সাধারণভাবে জঙ্গলমহল এলাকায় যে মফস্বল থানা বা ফাঁড়িগুলি আছে, সেখানকার পুলিশ কর্মীরা কি আর মনোবল নিয়ে কাজ করতে পারবে? গোটা রাজ্য পুলিশ, প্রশাসন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। কোন কোন মাওবাদী নেতা এই হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল, কোন স্কোয়াড যুক্ত ছিল, তা পুলিশ-প্রশাসন এবং গোয়েন্দা বিভাগ পরবর্তীকালে চিহ্নিত করতে পারলেও, তাৎক্ষণিকভাবে তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে সরকার মাওবাদীরা উৎসাহিত হয়। বাড়তে থাকে তাঁদের তৎপরতাও। এর দু-তিন মাসের মধ্যে ২৮ মে, ২০১০ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মধ্যেই, খড়্গপুর ও ঝাড়গ্রাম রেল স্টেশনের মধ্যবর্তী সরডিহার কাছাকাছি হাওড়া-মুম্বই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে মাওবাদীরা যে ভয়ঙ্কর নৃশংসতম নাশকতা ঘটায় তা মনে করলে এখনও সারা শরীর শিউরে ওঠে। এরকম নৃশংসতম নাশকতার ঘটনা রাজ্যের মানুষ অতীতে কখনও দেখেননি। সাধারণ মানুষ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রাতের ট্রেনে রিজার্ভেশন করে রওনা হয়েছেন, এইরকম কয়েকশো মানুষকে সেই নাশকতার স্বীকার হতে হয়। প্রায় দেড়শ মানুষ নিহত হন। সহজ করে বললে বলা যায়, তাঁদের খুন করা হয়। আরও কয়েকশো মানুষ গুরুতর আহত হন এতে। ঘটনার দিন ভোর রাত্রে পুলিশ মারফত টেলিফোনে খবর পেলাম। আমি সেদিন জেলায় চন্দ্রকোণা রোডের বাড়িতেই ছিলাম। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকাল হওয়ার পূর্বেই ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হলাম। ঘটনাস্থল এতটাই দূর্গম যে, গাড়ি করে সেখানে যাওয়াই অসম্ভব ব্যাপার। লোকাল থানার পুলিশের সাহায্যে সূর্য ওঠার পূর্বেই সেখানে পৌঁছোই। পৌঁছনোর পর যা দেখলাম তা এক কথায় বর্ণনা করা খুব কঠিন। সে এক ভয়ঙ্কর হৃদয়বিদারক দৃশ্য। এই ঘটনা নিয়ে সে সময় সংবাদমাধ্যমেই বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল।
বেলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই দুর্ঘটনার কারণে সেই মৃতদেহগুলির অধিকাংশের এমনই অবস্থা যে, তা দেখাও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মৃতের সংখ্যা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের অন্তর্গত সব উদ্ধারকারী শাখাও দ্রুত উপস্থিত হয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেছে। এরপরেও ঘটনার গভীরতায় আর্মির সাহায্য নেওয়া হয়। তৎকালীন রেলমন্ত্রী থেকে শুরু করে রেল প্রশাসন, এ রাজ্যের সর্বোচ্চ স্থানাধিকারীরা ঘটনাস্থলে দ্রুত এসে হাজির হন। রাজ্য প্রশাসন ও আর্মির সাহায্যে উদ্ধার কাজ দ্রুততার সঙ্গে চলতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘটনাস্থলে আসতে শুরু করেন। তেমনই, যে যাত্রীরা এই ট্রেনে যাত্রা করেছিলেন, তাঁদের আত্মীয় পরিজনেরাও খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছোতে শুরু করেন। ওই লাইনে ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে শুধু মানুষ আর মানুষ। স্বজন হারানো মানুষ, ঘটনায় আহতদের পরিবার, এলাকার সাধারণ মানুষ, প্রশাসনিক আধিকারিক থেকে উদ্ধারকারী দল, সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা।
এই অবস্থার মধ্যেই রেল দফতরের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী (বর্তমানে রাজ্যের মখ্যমন্ত্রী) বেলা ১০ টা নাগাদ হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থলে আসেন। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি একটি অস্থায়ী হেলি প্যাডে উনি নামেন। সে সময় আমি ও আমাদের জেলা থেকে নির্বাচিত আরও এক মন্ত্রী রবিলাল মৈত্র জেলা প্রশাসনের উচ্চ আধিকারিকদের সঙ্গে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে উদ্ধার কাজ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এমন সময় দেখলাম রেলমন্ত্রী আমাদের দিকে আসছেন। উনি সামনা-সামনি হয়েছেন দেখে, আমি ওনাকে কিছু বলতে গেলাম, কিন্তু তিনি তখন উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি চলে গেলেন। প্রায় বিকাল পর্যন্ত ঘটনাস্থলে থেকে, তারপর সেখান থেকে খড়গপুর রেল হাসপাতালে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে সন্ধ্যার পর চন্দ্রকোণার বাড়িতে ফিরে আসি। সেদিন সারা দিনের ঘটনায় এতই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, সেদিন আর টিভি দেখার মতো অবস্থা ছিল না। পরের দিন জানতে পারি, ট্রেনের এই নাশকতার ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যেই কলকাতার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এই নাশকতার ঘটনায় সিপিএম যুক্ত আছে বলে খুবই সোচ্চার হয়েছে। এনিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনও হচ্ছে। পরবর্তীতে এই ঘটনার তদন্তভার রাজ্য ও কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সিবিআই তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত মাওবাদী ও জন সাধারণের কমিটি। সরাসরি যারা যুক্ত তাদের অনেককে গ্রেফতারও করা হয় সিবিআইয়ের তৎপরতায়। কোনওভাবেই তদন্তে সিপিএমের নাম আসেনি। অথচ সিপিএম ও বামফ্রন্টকে হেয় করতে, সিপিএমের বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তোলার জন্য যে বুদ্ধিজীবীরা চরম মিথ্যাচার করলেন, পরবর্তীকালে তাঁরা কেউ এর জন্য দুঃখ প্রকাশের সৌজন্যতাটুকুও দেখিয়েছেন বলে বাংলার মানুষ কখনও দেখেননি। কালের স্রোতে মানুষের মন থেকে এই ঘটনা হালকা হয়ে যাবে এটা ঠিকই, কিন্তু রাজনীতির নামে ভয়ঙ্কর এই ঘটনায় যাঁরা চলে গেলেন, যাঁরা সুস্থ হলেন বা যাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারলেন না, তাঁদের পরিবারকে সারা জীবন এই ঘটনা যন্ত্রণা দেবে। আর রাজনীতির নামে যাঁরা এই মারণ যজ্ঞ সংগঠিত করল, সেই রাজনীতিকেও কি মানুষ সমর্থন করবেন? কোনও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ কখনও এই ঘটনাকে সমর্থন করতে পারেন না। যাঁরা নিছক উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত সংকীর্ণ রাজনীতি করার জন্য এই ঘটনাকে আড়াল করে, সেই সময়ে মিথ্যা প্রচার চালিয়েছিলেন সিপিএমকে কালিমালিপ্ত করার জন্য, তাঁরা কি কোনও দিন নিজেদের প্রশ্ন করবেন যে, কেন এটা করেছিলেন? এরপর অনেকগুলি বছর কেটে গেছে, এই বিষয়টি এখনও আদালতের বিচারাধীন। হয়তো আরও বহু বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইন কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখার জন্য।
এরপরেও প্রতিদিন মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল এলাকায় খুনের ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ মানুষের জীবন যাচ্ছে, কোনও দিন স্কুল পড়ুয়াদের চোখের সামনে তাদের প্রিয় শিক্ষক খুন হচ্ছেন। কোনও দিন স্কুলের মধ্যে অতর্কিতে হানা দিয়েও শিক্ষক বা শিক্ষা কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। পড়তে গিয়ে আর কলেজ ছাত্র বাড়ি ফিরে আসছে না, খুন হয়ে যাচ্ছে। স্কুল ছাত্ররাও এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আইসিডিএস মহিলা কর্মীদের খুন করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা খুন হচ্ছেন, হয় তাঁরা সিপিএম কর্মী, সমর্থক অথবা তাঁদের পরিবারের লোকজন সিপিএমের সমর্থক। সাধারণ পুলিশ কনস্টেবল থেকে কর্মচারী কারও রেহাই নেই। উদ্দেশ্য একটাই, এমনভাবে গোটা এলাকাকে আতঙ্কগ্রস্থ ও সন্ত্রস্ত করে দাও যে, তাঁরা যেন মাথা তুলতে না পারে। এটাই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনেও বামেরা জঙ্গলমহল এলাকায় তাঁদের যে সমর্থন অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে, তাকে একেবারে শেষ করে দিতে হবে। এই সব খুনের ঘটনা সেই বৃহত্তর পরিকল্পনারই অঙ্গ। প্রতিটি খুনের নৃশংস ঘটনা পৃথকভাবে উল্লেখ করা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। এর মধ্যে একদিন সকালে খবরে দেখলাম, তারিখটা আজ আর স্মরণে নেই, আগের দিন রাতে বিনপুর এলাকার তিন জনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে তাঁদের মৃতদেহ বাড়ির কাছে রাস্তার উপর ফেলে রেখে গেছে মাওবাদীরা।
এই ঘটনা জানার পর নিজের উত্তেজনা আর সংযত করতে পারিনি। সকালেই রাজ্য দফতরে তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড বিমান বসুকে বললাম, সরকার, পুলিশ-প্রশাসন থেকে আর লাভ কী? সাধারণ মানুষের জীবন যদি রক্ষা করা না যায়, তাহলে পুলিশ দফতর থাকবে কেন? কথাগুলো খুব কড়াভাবেই বলেছিলাম যে, আর কত রক্ত লাগবে, তবে পুলিশ প্রশাসন খুশি হবে বলতে পারেন? খুবই উত্তেজিত হয়ে এসব কথা ওনাকে বলেছিলাম। উনি নেতার মতোই একথা শুনে বলেছিলেন, ‘তুমি শান্ত হও। উত্তেজিত হয়ো না।’ পরে নিজেই ভাবলাম, বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার যে ষড়যন্ত্র, নিশ্চই পুলিশের উপর থেকে নীচ মহল পর্যন্ত এর একটা অংশ তাতে যুক্ত। তা না হলে কেন্দ্রীয় বাহিনী এরাজ্যের প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য থাকা সত্ত্বেও, প্রতিদিনই কী করে এত খুনের ঘটনা ঘটছে!
সেই সময় জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতোকে গ্রেফতার করা ছাড়া পুলিশ সেরকম কিছুই করতে পারছে না, এ হয় কী করে? অবশ্য সেই সময় কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে এনকাউন্টারে মাওবাদী স্কোয়াডের কিছু সদস্য মারা গেছে, এটা ঠিক। এর মধ্যে সিদু সোরেন ও শশধর মাহাতোর নাম উল্লেখযোগ্য। ছত্রধর মাহাতোর আপন ভাই শশধর মাহাতোর খুন হওয়া এবং ওই স্কোয়াডেরই অন্যতম নেত্রী তথা শশধরের স্ত্রী সুচিত্রা মাহাতোর অবস্থান নিয়ে পরের কোনও পর্বে উল্লেখ করব।
(চলবে)
Comments are closed.