আগের পর্বেই উল্লেখ করেছি, একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত তন্ময় চক্রবর্তী নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। এই ঘটনা ২০০৯ সালের শেষ বা ২০১০ এর প্রথম দিকের। চন্দ্রকোণা রোড লাগোয়া ডিগ্রি এম আর বাঙ্গুর টিবি সেনেটরিয়ামের লাগোয়া প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্যপাল হরেন মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত ট্রাস্টের টিবি আফটার কেয়ার সোসাইটির বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত জমি ও পরিকাঠামো যে পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়।
এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তন্ময়বাবু মহাকরণ আমার সাথে দেখা করেন ও বলেন, আফটার কেয়ার সোসাইটির পড়ে থাকা জমি ও পরিকাঠামো তাঁরা দেখতে চান। আমি সাথে সাথেই বলি, আপনারা কবে যাবেন বলুন। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব। আমি তখনই বিষয়টি স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষকে জানাই। এরপর ওনারা একটি তারিখ ঠিক করে আমাকে জানান। আমি ওনাদের বলি ওখানে গিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে। বলি, সব কথা বলা আছে। আপনারা গেলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এরপর উনি সরেজমিনে সবটা দেখে আসার পর একদিন মহাকরণে আমার ঘরে আসেন এবং আমাকে বলেন, ওনার ঘনিষ্ঠ পরিচিত লোকজন যাঁরা এনআরআই তাঁদের সাথে উনি কথা বলেছেন। তাঁরা ওনার কাছে ওই জায়গার পরিকাঠামো এবং জমির বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাতে বলেছেন। তার প্রেক্ষিতে উনি পরে বিস্তারিত তথ্য ও বিবরণ পাঠিয়েছিলেন। এর দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যেই আবার উনি মহাকরণে এসে বলেন, যাঁদের কাছে তথ্য পাঠানো হয়েছিল, তাঁরা আলোচনার পর জানিয়েছেন, ওই জায়গায় জমির যা পরিমাণ, যে পরিকাঠামো অবশিষ্ট আছে তাতে একটি মেডিকেল হাব করা যেতে পারে। সেখানে একটি ৫০০ বেডের হাসপাতালসহ একটি মেডিকেল কলেজ, একটি ডেন্টাল কলেজ, একটি নার্সিং কলেজ ও একটি প্যারা মেডিকেল কলেজ করা যেতে পারে। দু-তিনটি ভাগে কাজটি সম্পূর্ণ করা হবে। ওনারা পিপিপি মডেলে কাজটি সম্পন্ন করতে চান। এটা বাস্তবায়িত হলে একাধারে এলাকার মানুষ উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা যেমন পাবেন, তেমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হবে। এই ধরনের মেডিকেল হাব পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেও তখনও পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। আর সবথেকে বড় কথা হল, এর জন্য রাজ্যকে কোনও অর্থ ব্যয় করতে হবে না। জমি জায়গা ও যে পরিকাঠামো অবশিষ্ট রয়েছে তার উপরই এটা গড়ে উঠবে। এই প্রস্তাবে আমি এক কথায় রাজি হয়ে যাই। আনুষ্ঠানিকভাবে ওনাদের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলি। তখন ওনারা পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতরের কাছেই লিখিতভাবে প্রস্তাব জমা দেন। আমি বিভাগীয় সচিবের সাথে আলোচনা করি। তিনিও প্রস্তাবটি ভালো বলে উৎসাহ দেন। এরপর ওনারা এবিষয়ে বিস্তারিত প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরিতে সচেষ্ট হন। খুব দ্রুত এই কাজ এগোতে থাকে। এই বিষয়ে আমার দফতরের সচিব, স্বাস্থ্য দফতরের সচিবের সঙ্গেও আলোচনা করেন এবং স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নিয়ে ওই স্বচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সদস্যদেরও তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেন।
এখানে আরও একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৯৮৫ সালে বিধানসভা উপনির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আমি যখন বিধায়ক নির্বাচিত হই, সে সময় হরেন মুখার্জি মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অধীন টিবি আফটার কেয়ার সোসাইটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল, তা বন্ধ হয়ে গেলেও তখনও তার কিছু কর্মচারী থেকে যান। মূলত এই সোসাইটি যখন গড়ে উঠেছিল, সেই সময় টিবি অর্থাৎ যক্ষা রোগ ছিল দুরারোগ্য। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হলেও, সমাজ বা পরিবার জীবনে তাঁদের ফিরে যাওয়া ছিল খুবই কঠিন কাজ। তাই এই ব্যধিতে আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে খুবই দূরাবস্থার মধ্যে পড়তে হোত। এই ট্রাস্ট গঠিত হয় এই উদ্দেশ্য নিয়েই যে, এই ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হওয়ার পরে এই সোসাইটি থেকে বিভিন্ন কাজের ট্রেনিং নিয়ে যাতে তাঁরা আর্থিক দিক থেকে কিছুটা সাবলম্বী হতে পারেন। যাতে পরবর্তী জীবনে তাঁদের কিছুটা আর্থিক সুরাহা হয়। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির পথ বেয়ে এক সময়ে এই রোগে আক্রান্ত মানুষ চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থতা অর্জন করে ও তারপর সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে ফিরে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠে। যার ফলে সময়ের নিয়মে এই ক্যাম্পগুলি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এই প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলিতে বিভিন্ন দফতর থেকে ডেপুটেশনে থাকা প্রশিক্ষকরা কেউ পরে অবসর নেন। কেউ বা মূল দফতরে ফিরে যান। কিন্তু সোসাইটির কিছু কর্মচারী, যাঁরা তখনও অবসর নেননি তাঁরা থেকে যান। তাঁরাই একদিন সংগঠিতভাবে, আমি এলাকায় বিধায়ক হওয়ার জন্য আমার সাথে দেখা করেন। তাঁদের কাছ থেকে এই ডিগ্রি আফটার কেয়ার সোসাইটির হরেন মুখার্জি নামাঙ্কিত ট্রাস্টের সমস্ত কাজকর্মের বিষয়ে অবগত হই এবং তাঁরাই আমাকে জানান, পদাধিকারবলে এই ট্রাস্টের সভাপতি হলেন রাজ্যের রাজ্যপাল ও অন্যদের সঙ্গে ট্রাস্টের সদস্য হলেন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। যদি আমি উদ্যোগ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিকাঠামো এবং সম্পত্তিসহ এই ট্রাস্টকে সরকারের অধীনে নিয়ে আসি তা হলে অবসর না নেওয়া কর্মীরাও সরকারি সুযোগ সুবিধা পাবেন এবং এর জমি ও পরিকাঠামো রক্ষা পাবে।
ওনারা তখন একদিন লিখিতভাবে আমায় অনুরোধ করেন, এই ট্রাস্টের পরিকাঠামো দেখতে যাওয়ার জন্য। ওনাদের সাথে তারিখ ঠিক করে আমি একদিন ওখানে যাই। সবটা দেখার পর আমার মনে হয়, এই বিশাল পরিকাঠামো প্রায় ধ্বংসস্তুপের মতো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিপুল জমির কিছু কিছু অংশ বেদখলও হতে শুরু করেছে, যদি কিছু ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তবে এই পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে, জমিও দখল হয়ে যাবে। আমার এই ব্যক্তিগত ধারণার পর ওই সোসাইটির কর্মীদের বিস্তারিত আবেদন পত্র বিধায়ক হিসাবে আমার কাছে জমা দিতে বলি এবং এই আবেদন পত্রের সাথে ট্রাস্টের বিস্তারিত তথ্য, পরিকাঠামো, আনুমানিক আর্থিক মূল্য উল্লেখ করার কথা বলি। তখন তাঁরা আবেদনপত্র নিয়ে আমার কাছে আসেন। অনেক কোটি টাকার সম্পত্তি এবং এই সোসাইটির সমস্ত তথ্যসহ একটি আবেদন পত্র স্থানীয় বিধায়ক হিসাবে তাঁরা আমাকে দেন।
আমি আবেদন পত্র সাথে নিয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাননীয় প্রশান্ত শুরের সাথে সাক্ষাৎ করি। উনি সব ঘটনা জেনে বলেন, ‘এত বড় প্রপার্টি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা অবশ্যই করা উচিত। তুমি এক কাজ করো, ওদের আবেদন পত্রের সঙ্গে বিধায়ক হিসাবে একটা চিঠি আমাকে দাও। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সময় করে মাননীয় রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সব আলোচনা করব। তারপরে তোমাকে জানাব। তুমি ১০-১৫ দিন পর আমার সাথে দেখা করবে।’ এরপর যেদিন ওনার সঙ্গে পুণরায় সাক্ষাৎ করার জন্য মহাকরণে যাই সেদিন উনি আমাকে বলেন, ‘এ নিয়ে মাননীয় রাজ্যপালের সাথে কথা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উনি খুবই ইতিবাচক। তোমার কথা ওনাকে বলেছি। তোমার চিঠির সঙ্গে মন্ত্রী হিসাবে আমাকেও একটি চিঠি দিতে বলেছেন তিনি। তাও খুব দ্রুত আমি ওনার কাছে পাঠিয়ে দেব। এরপর কী হয় দেখা যাক।’
এর কিছুদিন পরে প্রশান্তদা আমাকে রাজভবনে নিয়ে যান। তখন এই রাজ্যের রাজ্যপাল ছিলেন অধ্যাপক নুরুল হাসান। জীবনে সেই প্রথমবার রাজভবনে যাওয়ার সুযোগ হয়। প্রশান্তদা পরিচয় করিয়ে দেন, উনি খুবই সজ্জন মানুষ ছিলেন। বললেন, বিষয়টি নিয়ে নিজের সচিবকে উনি ট্রাস্টি বোর্ডের সভা ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ওনার নির্দেশ মতো নির্ধারিত সভা হয়। সেই সভাতে ট্রাস্টের সদস্য হিসাবে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশান্ত’দাও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ট্রাস্টের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকারকে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঠিক হয়, ট্রাস্টের যে কর্মচারীরা তখনও অবসর নেননি তাঁরা সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা পাবেন। এবং সরকার তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সম্পত্তি সরকারি কাজে ব্যবহার করতে পারবে। এই সিদ্ধান্তও ঐ ট্রাস্টি বোর্ডের সভা থেকে নেওয়া হয়। এর মাস খানেক পরেই এই রাজ্য থেকে উনি চলে যান। এরপর টানা ৫ বছর আমি বিষয়টি নিয়ে একবার রাজভবনে চিঠি লিখি, একবার স্বাস্থ্য দফতরে খোঁজ নিই। দু’লাইনের উত্তর পাই, ‘বিষয়টি আন্ডার প্রসেস।’ এর পাঁচ বছর পরে রাজ্যপাল হিসাবে পুণরায় অধ্যাপক নুরুল হাসান এরাজ্যে ফিরে আসেন। আমি আবার সরাসরি ওনাকে চিঠি পাঠাই। উনি আমাকে ডেকে পাঠান। ওনার দেওয়া নির্ধারিত সময়ে আমি রাজভবনে যাই। উনি সব শোনার পর বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর পূর্বে যে সিদ্ধান্ত করে দিয়ে গেলাম, তা এতদিনেও কার্যকর হয়নি!’ উনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘দেখি আর কত দিন লাগে।’ এরপর দ্রুত হস্তান্তরের কাজ সম্পন্ন হয়। এছাড়া তেমন কোনও কাজ আর হয়নি। কেবলমাত্র যেকজন কর্মচারী তখনও থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি পান।
এর মধ্যে অনেক বছর চলে গেছে, জমি বেদখল হয়েছে, পরিকাঠামো আরও নষ্ট হয়েছে। কাঠের দরজা, জানলা, আসবাবপত্র সব চুরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সূর্যদা (সূর্যকান্ত মিশ্র) স্বাস্থ্য দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। ওনাকে সব বিষয়ে অবগত করার পর উনি বলেন, কলকাতার বউবাজারে স্বাস্থ্য দফতরের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে, সেটি স্থানান্তর করে ডিগ্রি আফটার কেয়ার সোসাইটিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আবার কিছু দিন পর ওনার নিকট খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ওখানকার কর্মচারীরা কলকাতা ছেড়ে প্রায় ২০০ কিমি দূরে চাকরি করতে যেতে রাজি নন। তাঁরা আদালতে মামলা করেছেন। তখনই বুঝে গেলাম, এর পরের পরিণতি কী হবে?
(চলবে)
Comments are closed.