বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা সিপিএমের মুল্যায়নে বিরোধ কেন? প্রশ্ন সিপিএমের অন্দরেই
বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লিগের কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের মূল্যায়নে কি বাংলা এবং ত্রিপুরার সিপিএমের মধ্যে কোনও মতবিরোধ আছে? অন্তত, বাংলাদেশের নির্বাচনী ফলাফলের পর সোমবার এই দুই রাজ্যের সিপিএমের দলীয় মুখপত্র দেখে তেমনই ইঙ্গিত মিলছে।
বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনে কার্যত একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে আওয়ামী লিগের। ৩০০ টি আসনের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ আসনেই জিতেছে তারা। আর আওয়ামী লিগের প্রাপ্ত ভোটের হিসেব দেখেও চোখ কপালে উঠেছে বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের। অধিকাংশ আসনেই ৯০-৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন শেখ হাসিনার দলের প্রার্থীরা। ৩০০ টি আসন নয়, শুধু প্রধানমন্ত্রীর আসনের ফল দেখলেই খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যাবে বাংলাদেশের নির্বাচনের ছবিটা। ঢাকার গোপালগঞ্জ ৩ নম্বর কেন্দ্রে শেখ হাসিনা পেয়েছেন ২ লক্ষ ২৯ হাজার ৫৩৯ টি ভোট, সেখানে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী পেয়েছেন ১২৩ টি ভোট। না, টাইপিংয়ের কোনও ভুল নয়, শেখ হাসিনার বিরোধী প্রার্থী কোনওক্রমে ১০০ ভোটের কোঠা পার করেছেন।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নির্বাচনকে প্রহসন আখ্যা দিয়ে সরব হয়েছে সে দেশের বিরোধী দলগুলি। ফের নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছে তারা।
কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ হয়েছে, না সেখানে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে তার হদিশ করার জন্য এই লেখা নয়। আসলে, পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র নেই বলে গত প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরে এরাজ্যে স্লোগান তোলা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বাংলাদেশের নির্বাচনের কী ব্যাখ্যা করে তা বোঝার চেষ্টা করাই এই লেখার উদ্দেশ্য। পাশাপাশি এটাও দেখা দরকার, এবছরের গোড়ায় ত্রিপুরায় বিরোধী আসনে বসা সিপিএমই বা কী চোখে দেখছে শেখ হাসিনার পার্টির একাধিপত্যকে।
সোমবার পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় বাংলাদেশের নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছ। যার হেডলাইন, ‘অপ্রতিহত হাসিনা, জামাতের জামানতই বাজেয়াপ্ত’। অন্যদিকে, ত্রিপুরা রাজ্য সিপিএমের মুখপত্র ‘ডেইলি দেশের কথা’ পত্রিকাতেও এদিন প্রথম পৃষ্ঠায় খবর প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে। যার হেডলাইন, ‘বাংলাদেশে ব্যাপক জয় আওয়ামী লিগের, এককথায় ভোট ডাকাতিঃ বিরোধী ঐক্যফ্রন্ট’।
দুটি খবরের হেডলাইনেই প্রাথমিকভাবে স্পষ্ট, পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম মুখপত্র হাসিনার জয় নিয়ে দৃশ্যত যতটা উচ্ছ্বসিত, ততটা উচ্ছ্বাস নেই ত্রিপুরা সিপিএমের মুখপত্রে। বরং ভোট লুঠ বা সন্ত্রাসের যে অভিযোগ নির্বাচনের আগে থেকেই বিরোধীদের পক্ষ থেকে তোলা হচ্ছিল, বা ভোটের পরও যা নিয়ে সরব হয়েছে সে দেশের বিরোধী দলগুলি, তার যথাযথ একটা স্বীকৃতি সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকারের রাজ্যের পার্টি মুখপত্র দিয়েছে। কিন্তু এ তো গেল, ‘গণশক্তি’ এবং ‘ডেইলি দেশের কথা’র হেডলাইনের কথা। কী আছে মূল খবরে?
‘ডেইলি দেশের কথা’র খবরের প্রথম প্যারাগ্রাফের প্রথম তিন লাইনে আওয়ামী লিগের জয়ের খবর দিয়ে চতুর্থ লাইনেই লেখা হয়েছে, ‘তবে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হিসাবে প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে গেল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। নির্বাচনি হিংসায় এখনও পর্যন্ত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এই ভোটকে প্রহসনাত্মক বলে উল্লেখ করে ফল প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে তা বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন।’
শুধু এখানেই থামেনি ত্রিপুরা সিপিএমের মুখপত্র। খবরের দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফও শুরু হয়েছে নির্বাচন যে অবাধ হয়নি সেই অভিযোগের কথা উল্লেখ করে। শুধু তাই নয়, গোপালগঞ্জ ৩ নম্বর আসনে শেখ হাসিনা এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কত ভোট পেয়েছেন তাও উল্লেখ করেছে ‘ডেইলি দেশের কথা’। পুরো খবরেই নির্বাচনে ফলের থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে বারবার লেখা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সে দেশের বিরোধী দলগুলির অভিযোগের কথা।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পত্রিকার প্রতিবেদনে কী লেখা হল? খবরের প্রথম লাইন, ‘জামাতের জামানত বাজেয়াপ্ত করে জিতল বাংলাদেশ। বিধ্বস্ত বিরোধীরা। বাংলাদেশ শেখ হাসিনার। টানা তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হাসিনা। জয়ের আভাস নিশ্চিত হতেই হাসিনা বিজয় উৎসব না করার জন্য দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছেন, এখন আনন্দ মিছিল করার সময় নয়, এখন দেশ গঠনের সময়। কোনও জায়গায় কেউ আনন্দ মিছিল করবেন না।’ না, সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে কিছু লেখা নেই প্রথম প্যারাগ্রাফ, দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফ বা তার পরেও।
‘গণশক্তি’র খবরে পাঁচ নম্বর প্যারাগ্রাফের শুরু হচ্ছে এভাবে, ‘যথারীতি, বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্ট ”প্রহসনের এই নির্বাচন বাতিল করার” দাবি জানিয়েছে।’ এরপর বিরোধীদের অভিযোগ নিয়ে দু’তিনটি লাইন লেখা হয়েছে ‘গণশক্তি’র খবরে। তাছাড়া এই নির্বাচনকে পুরোপুরি প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে বলে বিরোধীদের যে অভিযোগ তা আর কোথাও উল্লেখ নেই এই খবরে।
‘গণশক্তি’র খবরে দুটি শব্দ অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ণ। প্রথমটি ‘জিতল বাংলাদেশ’ এবং দ্বিতীয়টি ‘যথারীতি’। ‘গণশক্তি’র খবর পড়লে যে কেউ মনে করতেই পারেন, পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের মুখপত্র মনে করে, কোনও নির্বাচনে শাসক দল ৯০ শতাংশের বেশি আসন ৯৫-৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতলে তা সেই দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে এতটাই স্বাভাবিক ঘটনা যে, নির্বাচনে সন্ত্রাসের যে অভিযোগ বিরোধীরা তুলেছে সেই খবর লেখার সময় শুরুতে ‘যথারীতি’ শব্দটি ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যার সহজ মানে, বিরোধীদের এই সব অভিযোগ এতই গুরুত্বহীণ যে ‘যথারীতি’ বিরোধীরা তা করেছেন!
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট পরিচালিত ‘গণশক্তি’ বাংলাদেশের নির্বাচনে বিরোধীদের এই অভিযোগকে এভাবে গুরুত্বহীণ করে দিল কেন? কেনই বা ত্রিপুরা সিপিমের মুখপত্র এই বিষয়টিকেই মূল ফোকাস করে প্রতিবেদন প্রকাশ করল? এই দুই প্রশ্নের উত্তরও আছে, কিন্তু তা এই লেখার বিষয় নয়।
ছোট্ট একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করব। ২০১৩ সালের শুরুতে রাজাকারদের চরম শাস্তির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয় বাংলাদেশে। আন্দোলন শুরু হওয়ার চার-পাঁচদিন পর সেই ঘটনা কভার করতে আমি বাংলাদেশ যাই। আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম শাহবাগ চত্বরেরই ঢাকা ক্লাবে। ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে স্থানীয় ট্যাক্সিতে শাহবাগ যাচ্ছি। ঢাকা ক্লাবের থেকে ৪০০-৫০০ মিটার আগে এক জায়গায় দেখি রাস্তায় বাঁশের ব্যারিকেড। ৪০-৫০ জন আন্দোলনকারী যুবক-যুবতী রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে। ওই ব্যারিকেডের পর আর গাড়ি যাবে না। বুঝলাম সামনেই আন্দোলনস্থল। তাই রাস্তা আটকানো। কিন্তু সঙ্গে এত লাগেজ। ট্যাক্সি থেকে নামলাম আন্দোলনকারীদের নিজের পরিচয় দিয়ে বলতে যে, ঢাকা ক্লাবে আমরা থাকব। তাই আমাদের ট্যাক্সি যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। ট্যাক্সি থেকে নামতেই চোখে পড়ল বাঁশের ব্যারিকেডের ওপর আটকানো সাদা কাগজে কালো কালি দিয়ে লেখা, ‘সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। দেশ গঠনের কাজ চলছে, তাই রাস্তা বন্ধ’। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলা ঘুরে প্রচুর আন্দোলন কভার করেও আন্দোলনকারীদের এমন শব্দের ব্যবহার আগে কখনও দেখিনি। তারপর দু’সপ্তাহ ঢাকা, চট্টগ্রামে ছিলাম। বারবার শুধু মাথায় চক্কোর মারতো সেই লাইনটা, ‘দেশ গঠনের কাজ চলছে, তাই রাস্তা বন্ধ’।
৩০ শে ডিসেম্বর রাত থেকে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের ফল ঘোষণার মাঝেই আবার শুনলাম সেই বাক্য, আওয়ামী লিগের নেতা দলীয় কর্মীদের বলছেন, কেউ আনন্দ মিছিল করবেন না, এখন দেশ গঠনের সময়।
[সামান্য সতর্কবার্তাঃ ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনকারীদের দেশ গঠনের স্লোগান এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লিগের নেতার মুখে একই কথার মধ্যে কেউ মিল খুঁজবেন না দয়া করে।]
Comments are closed.