যাঁরা বাড়িতে বা ব্রিগেডে গিয়ে ডিম ভাত খান, কিংবা যাঁরা ‘ডিম ভাত’ এর সঠিক বানান জানেন না, তাঁদের নিয়ে যাঁরা কটাক্ষ করেন, মজা করেন, কিংবা দামী মোবাইল ফোনে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান পোস্ট করেন, তাঁরা বামপন্থী বলে আমি বিশ্বাস করি না। ঠিক সেভাবেই বিশ্বাস করি না, নিজের রাজ্য সম্পর্কে, মানে হবিবপুর থেকে রানীবাঁধ, গলসি থেকে সুন্দরবনের মানুষের সামগ্রিক শ্রেণী চরিত্র সম্পর্কে তাঁদের কোনও ধারণা আছে বলে!
এই লেখা কেন লিখছি, সেই প্রসঙ্গে আসার আগে একটা ঘটনার উল্লেখ করব। বিশ বছরের সাংবাদিক জীবনে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এমন খবর করেছি, পরে ভেবে দেখেছি, খবরটা না করলেই ভালো হোত। তেমনই এই ঘটনা। সেটা ২০০৬ বা ২০০৭ সাল হবে। ২০০৮ ও হতে পারে। বামেদের ব্রিগেড সমাবেশ। তার কিছুদিন আগেই জনস্বার্থ মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, দূষণ ঠেকাতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে গাড়ি পার্ক করা যাবে না, রান্না করা যাবে ইত্যাদি। আমি তখন এবিপি আনন্দ চ্যানেলে চাকরি করি, সেদিন সকাল ৭ টা-সাড়ে ৭ টা নাগাদ ব্রিগেড পৌঁছোই। ব্রিগেডে সকাল ৮ টার লাইভ করে ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে বেরোলাম ময়দান এলাকা ঘুরে দেখতে, কত মানুষ আসছেন, কী করছেন তার ছবি তুলতে। মহামেডান স্পোর্টিং মাঠের পাশের ময়দানে গিয়ে দেখি, প্রচুর মানুষের ভিড়। রান্না বসেছে। দুটো উনোন জ্বলছে। ভাত হচ্ছে একটায়, অন্যটায় ডাল। পাশে মাটিতে পলিথিন পেতে বসে কয়েকজন বাঁধা কপি কাটছেন।
ক্যামেরাম্যানকে বললাম ছবি তুলতে। আমি দু’একজনের বক্তব্য নিলাম। তাঁরা বললেন, ‘মাঝরাতে বাসে উঠেছি, এসেই রান্না চাপিয়েছি। খেয়েই মাঠে যাব।’ সহজ-সরল মানুষগুলো জানতেনও না কেন আমি তাঁদের বক্তব্য নিচ্ছি, জানতেন না কী আমার অভিসন্ধি! আধ ঘন্টা বাদে খবর করলাম, ‘হাইকোর্টে রায় অগ্রাহ্য করে ব্রিগেড সমাবেশে এসে ময়দানের পরিবেশ নষ্ট করে সিপিএম কর্মীদের ঢালাও রান্নার ব্যবস্থা’। এবিপি আনন্দ চ্যানেলে চলতে শুরু করল ‘ব্রেকিং নিউজ’। ঘন্টাখানেক হয়েছে, এদিন-ওদিক ঘুরছি। ভাবছি আবার ব্রিগেডে ফিরে যাব। লোকগুলো তখন ভাত নামিয়ে বাঁধা কপি চাপিয়েছেন উনোনে। সওয়া ৯ টা-সাড়ে ৯ টা হবে, গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদক এবং সিপিএম রাজ্য কমিটির সদস্য অভীক দত্ত ওই মাঠে এলেন। এসেই গাড়ি থেকে নেমে প্রচণ্ড বকা দিলেন ওই মানুষগুলোকে। লোকগুলো তো হতভম্ব। ডেকে আনলেন তাঁদের নেতাকে। তাঁকেও অভীক দত্ত বললেন, ‘এখনই রান্না বন্ধ করুন’। নেতা নির্দেশ দিলেন কর্মীদের। আমার ক্যামেরাম্যান ছবি নিচ্ছে। এরপর ঘটল এক মর্মান্তিক ঘটনা। যে মানুষগুলো রান্না করছিলেন তাঁরা জল দিয়ে উনোন নিভিয়ে দিলেন। বড় ডেচকিতে ভাত আর ডাল হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন গিয়ে রাগের মাথায় দুটো ডেচকিই উল্টে মাটিতে ফেলে দিলেন গরম ভাত, ডাল। তাই দেখে কয়েজন ভেঙে দিলেন উনোন, বাঁধা কপিও ফেলে দিলেন মাটিতে। তারপর রাগে, ক্রোধে দূরে মাটিতে গিয়ে বসে পড়লেন। আমি খবর করলাম, ‘আমাদের খবরের জেরে বন্ধ হল রান্না, বাঁচল পরিবেশ’।
আবার ফিরে গেলাম মূল সমাবেশে স্থলে। কিন্তু তারপর সারাদিন, বারে বারে স্মৃতিতে ফিরে এসেছে এই ঘটনা। আমার খবরের জন্য এতগুলো গরিব মানুষ, কত দূর থেকে এসেছেন, সামান্য ভাত, ডাল আর বাঁধা কপির তরকারিও খেতে পারলেন না। পরেও কতবার ভেবেছি, কী খেলেন লোকগুলো। আপশোষ করেছি এই খবর করা নিয়ে। ভেবেছি, আমার এই গরিব দেশে, গরিব রাজ্যে এ এক অমার্জনীয় অপরাধ। বহু বছর বারবার নিজেকে বলেছি, এমন অন্যায় আর জীবনে করব না। গরিব মানুষ কী খাবে, কীভাবে খাবে, কোথায় খাবে তা নিয়ে খবর করব না। পরিবেশ চুলোয় যাক, চুলোয় যাক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সৌন্দর্য! ভেবেছি, বড়লোক দুনিয়াজুড়ে পরিবেশের যে বারোটা বাজিয়েছে, তাতে কোতুলপুরের হত দরিদ্র ১০০ টা মানুষ বছরে একদিন ময়দানে ভাত, ডাল, বাঁধা কপি রান্না করে খেলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হবে?
আজ এত বছর বাদে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ‘ডিম্ভাত’ লেখা দেখে মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব লিখে কটাক্ষ করছেন, তাঁরা কি মনে করেন, যিনি ডিম ভাত খান বা তার যথার্থ বানান জানেন না, সেটা কি তাঁর বিলাসিতা? তিনি কি স্বেচ্ছায় ডিম ভাতের সঠিক বানান না জানা বেছে নিয়েছেন নিজের জীবনে? তিনিই তো একটা ডিম সেদ্ধ মিড ডে মিলে পাওয়া যাবে বলে তার ছেলে বা মেয়েটাকে স্কুলে পাঠান এই যুগেও, যে যুগে এশিয়ার সবচেয়ে বড়লোক এদেশেরই মুকেশ আম্বানী। সেই লোকটাই তো ডিমের দাম ৫০ পয়সা বাড়লে, দোকানে প্রশ্ন করেন, ‘আবার দাম বাড়ল’, আর দোকানদারকে বলেন, ‘একটু বড় দেখে দিন’। মুসুর ডালের দাম ১০০ টাকা ছাড়ানোর পর ডিমই তো এই লোকটার পরিবারের একমাত্র প্রোটিন! এই লোকটাই তো নিজে স্কুলে যেতে পারেননি। বছরের কোনও সময় ক্ষেত মজুর, কোনও সময় ভ্যান চালক, কখনও পুজোর মুখে ঢাকির অ্যাসিস্টান্ট হয়ে কলকাতায় আসেন, কখনও আবার দু’দিনের জ্বরে কাজ চলে যায় বলে বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে বসে থাকেন শুন্য দৃষ্টিতে। এই লোকটা জানতেও পারেন না, অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল নামে এক সংগঠন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, দেশের ৯ জন বিত্তবানের হাতে যে সম্পদ আছে তা ৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের সমান।
আচ্ছা, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই লোকটাকে নিয়ে মজাও করা যায়! মিড ডে মিলে ডিম ভাত কেন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, এই ফেসবুক পোস্টে যিনি লাইক করেন, তিনিই আবার ‘ডিম্ভাত’ নিয়ে কটাক্ষ করেন না তো? আশা করি, করেন না। আশা করি, তিনি বোঝেন, এই রাজ্যে ভূমি সংস্কার থেকে শুরু করে ২ টাকার চাল দেওয়া পর্যন্ত যত প্রকল্প সরকার নিয়েছে গত প্রায় ৫০ বছরে, সেই রাজ্যে এখনও অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষ, সে তিনি সিপিএম হোন, তৃণমূল হোন, বিজেপি হোন বা ঝাড়খন্ডিই হোন, তাঁদের শ্রেণী চরিত্র এক। এই মানুষগুলোকে এক ছাতার তলায় আসতে না দেওয়াই আজ ডানপন্থী, অতি ডানপন্থী দলগুলোর সামনে শেষ চ্যালেঞ্জ। এই লড়াই তারা জিতলেই আরও কোণঠাসা হবে বামপন্থা। এই চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে বামপন্থীদের সামনে বড় এবং একমাত্র লড়াই, দলীয় পরিচয় নয়, শ্রেণী চরিত্র দেখে মানুষকে জোটবদ্ধ করা। সেই লড়াইটাই দুর্বল হবে, যদি আজও বামপন্থীরা ভাবেন, গরিব এবং নিরক্ষর মানুষেরও ‘আমরা, ওরা’ আছে।
সামনেই বামেদের ব্রিগেড। আশা করব, তৃণমূলের রাজনৈতিক মোকাবিলায় নজর দেবেন হরেকৃষ্ণ কোনারের উত্তরাধিকারীরা। আশা করব, সিপিএম আমলেও যে লোকটা স্কুলে যেতে পারেননি বলে ডিম ভাতের মতো অনেক শব্দেরই সঠিক বানান জানেন না, তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তত কেউ বলবেন, ‘এমন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের দুনিয়ায় এই কটাক্ষগুলো করা ঠিক হয়নি।’
যদিও, ডিম ভাতের বানান জানেন না বলে গরিব, নিরক্ষর মানুষকে যাঁরা কটাক্ষ করেন, আমি এখনও বিশ্বাস করি, তাঁরা বামপন্থী নন।
Comments are closed.