এ কি ঐতিহাসিক ভুল, না ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন? তা ইতিহাসই বলবে, কিন্তু দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের আগে এই মুহূর্তে শুধু এটুকুই বলার, ইতিহাসে নাম তুলে ফেললেন সূর্যকান্ত মিশ্র। তীব্র কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান নিয়ে এক সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, সেই সূর্যকান্ত মিশ্রই সেই ঘটনার ২৩ বছর বাদে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার কথা লিখিয়ে আনলেন কেন্দ্রীয় কমিটির দলিলে। যা সব অংশেই ঐতিহাসিক।
সেটা ১৯৯৬ সাল। লোকসভা ভোটের পর জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব নিয়ে দু’ভাগে বিভক্ত দেশের তাবড় সিপিএম নেতারা। বাংলার সিপিএম নেতারাও স্পষ্টই দু’দিকে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম দেব, মহম্মদ সেলিমরা জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে তীব্র সওয়াল করলেন। উল্টোদিকে অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু সহ বহু নেতা। জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্ক শুরু হবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাঁরা বিতর্কে অংশ নেবেন বলে ঠিক হল, সেই দলের নেতা করা হল সূর্যকান্ত মিশ্রকে। সূর্যকান্ত মিশ্র তখন রাজ্যের মন্ত্রী, নিজের জেলা অবিভক্ত মেদিনীপুরে ক্ষমতাসীন দীপক সরকার গোষ্ঠীর চক্ষুশূল এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নবীন সদস্য। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সূর্যকান্ত মিশ্র তীব্র সওয়াল করলেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। বললেন, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সিপিএম প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ নিলে, তার চেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল আর কিছু হবে না। কেরলের শক্তিশালী সিপিএম নেতারা জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরুদ্ধেই ছিলেন। কিন্তু বাংলার ডেলিগেট টিমের নেতার এই ‘কেরল লাইন’ দেখে তাঁরাও একটু অবাক হয়েছিলেন সেদিন। শেষ পর্যন্ত হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা চাওয়া সত্ত্বেও ভোটাভুটিতে হেরে গেলেন তাঁরা। জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হননি। সিপিএমের অন্দরের অনেকেই জানেন, সেদিন সূর্যকান্ত মিশ্রর এই ভূমিকায় ক্ষুব্ধই হয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জ্যোতি বসু পরে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী না হওয়া ‘ঐতিহাসিক ভুল’।
মাঝের ২৩ বছরে গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। রাজ্যে তৈরি হয়েছে তৃণমূল কগ্রেস, দেশে ১৯৯৮ সালে প্রথমবার সরকার গড়েছে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন প্রকাশ কারাট। আরও অনেক কিছু বদলে গেছে দেশ-দুনিয়ায়। কিন্তু ২০১৫ সাল পর্যন্ত খুব একটা বদলালেন না সূর্যকান্ত মিশ্র। কংগ্রেস সম্পর্কে প্রায় একই অবস্থান থেকে গেল তাঁর।
২০১৫ সালের মাঝামাঝি কথাটা প্রথম প্রকাশ্যে আনলেন সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব। ইঙ্গিত দিলেন রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার। তখন কিন্তু সূর্যকান্ত মিশ্র সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হয়ে গিয়েছেন। গৌতম দেবের এই মন্তব্য নিয়ে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা শুরু হল সিপিএমে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করবে সিপিএম! এই ইস্যুতে রাজ্য কমিটি উত্তাল। তখনও কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও সরাসরি রাজনৈতিক সম্পর্কের বিরোধী সূর্যকান্ত মিশ্র। আর এই অবস্থাতেই সুদর্শণ চক্র ছাড়লেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দলীয় মুখপত্র ‘গণশক্তি’র ওয়েবসাইটে বললেন, ‘সিপিএম এবং বামেদের একার পক্ষে তৃণমূলকে হারানো সম্ভব নয়’। ব্যাস, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই এক লাইন বক্তব্যে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পাশ হয়ে গেল কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা জোটের লাইন। এরপর আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কিছু বলতে হয়নি, ২৩ বছর আগে কংগ্রেস প্রশ্নে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সওয়াল করে তাঁর বিরাগভাজন হওয়া সূর্যকান্ত মিশ্র এগিয়ে নিয়ে গেলেন কংগ্রেসের সঙ্গে রাজ্যে আসন সমঝোতার অ্যাজেন্ডা। বর্ধমান থেকে জলপাইগুড়ি বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে পার্টির রাজ্য নেতাদের তো বোঝালেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটিকে কে বোঝাবে? সেই দায়িত্বও বিমান বসু আর মহম্মদ সেলিমকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন নারায়ণগড়ের ঠাকুরদা গ্রামের বাসিন্দা সূর্যকান্ত মিশ্র।
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে আসন সমঝোতার পর কেন্দ্রীয় কমিটি প্রস্তাব নিল, বাংলার রাজনৈতিক লাইন দলের সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। তাতেও দমলেন না সিপিএম রাজ্য সম্পাদক। দৃঢ়ভাবে লড়ে গেলেন কংগ্রেস সম্পর্কে তাঁর পরিবর্তিত অবস্থান নিয়ে। আসন সমঝোতা করতেই হবে কংগ্রেসের সঙ্গে। সিপিএমের কোনও নেতা যা কখনও ভাবতেও পারেননি, তাই লিখলেন সিপিএমের ২০১৮ সালের রাজ্য সম্মেলনের সাংগঠনিক রিপোর্টে। লিখলেন, ‘কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা (২০১৬ সালে) রাজ্যে বিজেপির ভোটকে কমাতে সাহায্য করেছে’। আর এই ইস্যুতেই লাগাতার সওয়াল করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাশ করালেন এক ঐতিহাসিক তত্ত্ব, লোকসভা ভোটেও এক এক রাজ্যে এক এক রকম কৌশল নেবে সিপিএম। বিধানসভা ভোটে যা হয়, তা লোকসভা ভোটের জন্য পাশ করিয়ে নিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। আর ৩-৪ মার্চ, ২০১৯ কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে সিপিএমের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো লেখা হল, কংগ্রেস এবং সিপিএম তাদের জেতা আসনে একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেবে না। কংগ্রেস প্রশ্নে রাজ্য পার্টির এই ঐতিহাসিক জয় এমন এক সময়ে সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু, মহম্মদ সেলিমরা ছিনিয়ে আনলেন, যা এক বছর আগেও অনেকে অসম্ভব বলেই মনে করতেন।
আজ, এই মুহূর্তে রাজ্য সিপিএম নেতাদের একটা বড় অংশই কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার পক্ষে। গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারি রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে মাত্র ৪-৫ জন নেতা (অমল হালদার, অচিন্ত্য মল্লিক, কল্লোল মজুমদার, বিপ্লব মজুমদার, অপূর্ব পাল) এই আসন সমঝোতার বিরোধিতা করেছেন। বাকিরা হাত তুলে ভোট দিয়েছেন আসন সমঝোতার পক্ষে। সিপিএমের অনেকেই আজ বলছেন, ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পার্টি। আজ কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে যেমন অনমনীয় অবস্থান নিয়েছেন রাজ্য সম্পাদক, ২৩ বছর আগে তিনি একইরকম অনমননীয় অবস্থান নিয়েছিলেন জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিতর্কে। আর আজকের মতোই ২৩ বছর আগেও দলের অধিকাংশ নেতা জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন! আসলে রাজ্য সম্পাদক যা চান, রাজ্য সিপিএম তাই চায়, এটাই সিপিএমের দস্তুর।
কংগ্রেসকে নিয়ে সিপিএমের আজকের এই সিদ্ধান্ত আপাতত ইতিহাসের হাতে। যার মূল্যায়ন সমকালে দাঁড়িয়ে করা সম্ভব নয়, যার মূল্যায়ন করতে হবে ২৩ না হলেও, অন্তত কয়েক বছর বাদে!
Comments are closed.